top of page
anup m.jpg

অনুপ কুমার মুখার্জী

১) বর্তমান বাসস্থান : হাওড়া, শিবপুর
২) ২ রা এপ্রিল, ১৯৭৪ সালে বীরভূমে, দুবরাজপুর সার্কেলের অধীন চিনপাই নামে হল্কা ক্যাম্পে যোগদান
৩) পরবর্তী কালে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্কে যোগদান। বিভিন্ন শাখায় কাজ করার পর, চিফ ম্যানেজার হিসাবে 3৩১ শে আগস্ট, ২০১২ সালে অবসর গ্রহণ। বর্তমানে ঐ  ব্যাঙ্কের প্রশিক্ষণ কর্মশালায় এবং ঐ ব্যাঙ্কেরই  ন্যাবার্ড এর  প্রশিক্ষণ শিবিরে আংশিক সময়ের  প্রশিক্ষক হিসাবে কর্মরত।
৪) মোবাইল ফোন নং ৯৮৩১১১১২০৫


 

শর্মাজীর হাসি আর অনিকেতের সাবাসি


চিনপাই স্টেশনে নিচু প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে শ্যামল বাবু মানে শ্যামল চ্যাটার্জি উল্টো দিকের জঙ্গল দেখিয়ে অনিকেতকে বলছিলেন- ভাই- এই যে জঙ্গল দেখছেন, এটা এখান থেকে আরম্ভ হয়েছে, আর চলে গেছে রাধামাধবপুর হয়ে একদিকে মোদাপা হয়ে ভোঁড়া, আর এক দিকে সোজা দুর্লভপুর হয়ে কচুজোড়ের দিকে। বিশাল জঙ্গল, মাঝখান দিয়ে চওড়া মোরাম দেওয়া রাস্তা, রাত্রির 7টার পর আর লোক চলে না। অনিকেত হাঁ করে দেখছিলো, দেখছিলো না, মনে হয় গিলছিলো!
ও হরি, শ্যামল চ্যাটার্জির পরিচয়ই তো আপনাদের দেওয়া হয় নি, তার ওপর অনিকেত এখানে কি করে এসে পড়লো, সেকথাই তো বলি নি! এই আমার দোষ! আমাকে অনেকেই বলেছেন- ওহে সাহিত্যের লেখক হতে চাও না পরীক্ষায় রচনা লিখতে চাও! কোনো পাঠকই তোমার এই লেখা পড়বে না হে! সাহিত্য রচনার একটা ব্যকরণ আছে, সেটা জানা আছে কি? --আগে অনিকেত কি করে এখানে এলো, তারপরে শ্যামল চাটুজ্জে কে সেটা বলো, তারপর নাহয় বিভূতিভূষণের মতো লবটুলিয়ার জঙ্গলের গপ্পো শোনাবে! বলিহারি সাহিত্যিক আমার!
সত্যিই খুব ভুল হয়ে গেছে।
তাহলে আগে সেই কথাই বলি।
আগে অনিকেতের কথা, যেখানে বাঙালিরা সেই 1973- 74 সালে দায় না পড়লে শিবপুর চ্যাটার্জিহাট থেকে গড়িয়াহাট যেতো না, বা সাঁত্রাগাছি থেকে বেলগাছিয়া যেতো না, সেখানে অনিকেত হাওড়ার চ্যাটার্জিহাট- শিবপুর থেকে বীরভুমের চিনপাই- নারায়ণপুর গেলো কেন?
আর কেন! সেই দায়ে পড়ে। আর এ হলো ভীষণ দায়! চাকরি করার দায়। আর যেমন তেমন চাকরি নয়, একেবারে গেজেটেড অফিসারের চাকরি, তাও 21 বছর বয়সে! না গিয়ে উপায় আছে।
আজ থেকে প্রায় 50 বছর আগের কথা হবে। সবে ভূমি সংস্কার বিভাগে কানুনগো হিসেবে অনিকেত চাকরি পেয়েছে। চিনপাই বলে একটা গ্রামে ( অধুনা  বক্রেশ্বর পাওয়ার প্ল্যান্ট এর জন্য বিখ্যাত) পোস্টিং পেয়েছে। সঙ্গে আর এক সাথী পাশের নারায়ণপুর হলকায়-  বিজয় মজুমদার। চিনপাই আর নারায়ণপুর যেন একই বৃন্তে দুটো গ্রাম, যমজ গ্রামও বলা চলে।  প্রথম দিন গ্রামে গিয়ে কি হলো, তার পরের  সাতদিন কিভাবে কাটলো, তার গল্প নাহয় আর এক দিন শোনানো যাবে, কিন্তু তার আগে, অনিকেতের এই অভিজ্ঞতার কথা, যেটা অনিকেতের মনে একেবারে দাগ কেটে বসে গেছে, সেটার কথাই এখন বলি।
চিনপাইতে পোস্টিং এর দিন সাতেক পরেই অর্ডার এলো, ওদের সবাইকে দুবরাজপুর সি ক্যাম্পে জয়েন করতে হবে। শুধু কানুনগোরা নয়, পেশকার, আমিন, জাঁচ মোহরা (জে এম), সবাইকে। তা বেশ বড় সড় দলই হলো। এর মধ্যে বিজয় এবং অনিকেতের পেশকার, আমিন, জে এম সবাই সিউড়ির ছেলে। ঠিক হলো অন্ডাল - সাইথিয়া লাইনের ট্রেন ধরে অফিস যাওয়া এবং ফেরা দুটোই ভালোভাবে চলতে পারে। কারণ ঠিক ঐ সময়েই অফিস যাত্রীদের জন্যে সাইথিয়া- সিউড়ি-চিনপাই-দুবরাজপুর- পাঁচড়া - ভীমগড় - পাণ্ডবেশ্বর- অন্ডাল ট্রেন যায় এবং ফেরেও অফিস ফেরত যাত্রীদের নিয়ে।
কিন্তু ওরা একটা জিনিস জানতো না- সেটা হলো,  ফেরার এই ট্রেন শুধু অফিস যাত্রী নয় অগুনতি পুরুষ মহিলা কয়লা পাচারকারীদের জন্যেও  বিখ্যাত ছিলো। সেটার কথায় পরে আসছি।
তা বিজয়ের পেশকার ফজলে কাদের ছিলো আবার নেতা! যে সে নেতা নয়, জে্লা সেটেলমেন্ট কর্মচারী ইউনিয়নের মানে পেশকার, আমিন, জে এম কর্মী সংগঠনের জেলা সেক্রেটারি। সেই সূত্রে সে অনিকেতকে বহু সংকট থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। সে গল্প অন্য কোনোদিন করা যাবে। নেতা হলে কি হবে, ভীষণ ভালো ছিলো ওর ব্যবহার! তখন বীরভূমের নেতা ছিলেন কংগ্রেসের সুনীতি চট্টরাজ। সোনাদা নামেই বিখ্যাত ছিলেন। তা ঐ কাদের কথায় কথায় পরের দিকে দুপুর 12 টার সময়ে- স্যার , সোনাদা ডেকেছেন- বলে অফিস থেকে চলে যেতো!
কি করে ডাকলো? তখন তো ফোনই ছিলো না, মোবাইল ফোন তো কল্পনার  বাইরে, তাহলে সোনাদা ডাকলো কি করে?  
একদিন অনিকেত জিজ্ঞাসাও করে ফেলেছিলো, তা কাদের উত্তর দিয়েছিলেন, অফিসে আসার সময় উনি বলে দিয়েছিলেন।
তখন তখন অনিকেতের খারাপ লাগলেও পরে 1977 থেকে 2011 সাল পর্যন্ত  এর অনেক উন্নত এবং শিল্পসম্মত রূপ অনিকেত দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো।
তো সেই প্রথম যখন চিনপাই স্টেশনে দুবরাজপুর যাওয়ার ট্রেন ধরবে বলে স্টেশনে ও আর বিজয় গিয়েছিলো, তখনই আলাপ হয়েছিলো শ্যামল বাবুর সঙ্গে। ভদ্রলোক স্টেশন মাস্টার, টিকিট বুকিং অফিসার, টিকিট কালেক্টর, পার্সেল অফিসার- সব। একা একটি কোয়ার্টারে থাকেন। পাশে থাকে আর একটি কর্মচারি, সে লাইন ম্যান, সিগন্যাল ম্যান, পয়েন্টস ম্যান-সেও সবকিছু।
পরে অনিকেত জেনেছিলো দূরে কেবিন ম্যান একজন আছেন। কিন্তু তার ব্যাপারে শ্যামলবাবু বিশেষ কিছু জানান নি।
এই শ্যামল বাবু যখন অনিকেত দের এখানে আসার কারণ শুনলেন, তখন বললেন- আপনারা তো প্রায় তিন মাস দুবরাজপুর যাতায়াত করবেন, তা এখান থেকে মান্থ্লি টিকিট না কেটে পাণ্ডবেশ্বর থেকে সাইঁথিয়া পর্যন্ত টিকিট কেটে রাখুন, অনেক সুবিধা হবে। তিনমাসের ভাড়াও মাত্র 15 টাকা। এমনিতে দুবরাজপুর থেকে চিনপাই বা সিউড়ি ভাড়া 25 পয়সা। সত্যিই অনেক সস্তা। যাইহোক, সেদিনের মত রিটার্ন টিকিট কেটে ট্রেনে উঠে পড়লো অনিকেত আর বিজয়। মোটামুটি ফাঁকাই ট্রেন। কাদের, নিখিল , স্বপন, সেলিম প্রদীপ, বিজনদের সঙ্গে দেখাও হয়ে গেলো। ওদের সঙ্গে আরো অনেকে ছিলো, সবাই দুবরাজপুরের বিভিন্ন হল্কা তে স্থায়ী পোস্টিং কিন্তু এখন সবাইয়েরই সি ক্যাম্পে গতি। যতটা সম্ভব একদিনে পরিচয় হলো। সবাই কিন্তু  অবাক হয়ে  গেলো একটা কথা শুনে! অনিকেতরা ট্রেনের টিকিট কেটেছে শুনে! কাদেরই ওদের ধমক দিয়ে বলেছিলেন- টিকিট কেটেছেন, ঠিক করেছেন, স্যার, এদের কথা বাদ দিন। ওরা কেবল বলেছিলো- ফেরার সময় বুঝবেন স্যার, কেন টিকিট কাটতে বারণ করেছিলাম!  তো সেদিনই ফেরার সময় অনিকেত বুঝেছিলো!
পিলপিল করছে পুরুষ এবং মহিলা, মহিলার সংখ্যাই বেশি- সবাই প্রত্যেকে অন্ততঃ দশ বস্তা করে কয়লা নিয়ে উঠেছে। কামরায় দাঁড়াবার জায়গা নেই। তবে প্রায় সবাই এদের সকলকেই বসতে দেবার জন্যে জায়গা ছেড়ে দিলো। অনিকেত দেখছে আর ভাবছে কি ব্যাপার! স্বপন আর সেলিম খুলে বললো- স্যার এরা সবাই সকালের প্রথম ট্রেনে কেউ সাইঁথিয়া, কেউ সিউড়ি, কচুজোড়, কেউ আপনাদের চিনপাই, দুবরাজপুর থেকে অন্ডালে চলে যায়। সারাদিন ধরে   কয়লা বস্তায় ভরে, ফেরে এই ট্রেনে। এইগুলি বিভিন্ন বাড়িতে বিক্রি করে, অনেক কম দামে, এতে এদের সংসার চলে। পুরুষেরা পরিমাণে বেশি বিক্রি করে গুল কারখানায়, একটু বেশি দামের আশায়। এটাই এদের জীবিকা! অনিকেত স্তব্ধ হয়ে ভাবছিলো, দারিদ্র এই পর্যায়ের! তাহলে কি এডাম স্মিথ ঠিক বলেছেন- মানুষ যখন জন্মায়, তখন শুধু পেট নিয়ে নয়, দুটো হাত নিয়েও জন্মায়!
এক দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে চিনপাই ফেরে অনিকেত! রাত্রে যখন বলাই,  পরে যে  অনিকেতের চেন পিয়ন হবে, কয়লার উনুনে রান্না করছিলো, তখন, অনিকেত জিজ্ঞাসা করেছিলো, হ্যাঁ রে বলাই, এই উনুনের কয়লা কোথা থেকে কিনিস রে? বলাই একটু অবাক হয়েই উত্তর দিযেছিলো, ঐ যে বাচ্ছা বাচ্ছা মেয়েগুলান আসে না, ওদের কাছ থেকেই তো কিনি।
-কত দাম নেয় রে?
--- কত আর, এই 15 পয়সা,  20 পয়সা! রাধামাধবের ভোগের জন্যে যা  লাগে, তা ঐ মদন জ্যেঠু  দিয়ে দেন- তাও ঐ 20 পয়সা 25 পয়সায় হয়ে যায়!
এখানে জানিয়ে রাখা ভালো, বলাই, অনিকেতের চিনপাইয়ের  বাসাবাড়ির ঠিক সামনে এক মন্দিরের (রাধামাধব) পূজারীও বটে, আর মদন বাবু হলেন, অনিকেতের বাসাবাড়ির মালিক এবং ঐ রাধামাধব মন্দিরের একজন অন্যতম সেবাইত বা শরিক।
অনিকেত ভাবে, এই সামান্য কটি টাকা, সারাদিনে হয়তো 1 টাকা বা খুবজোর 2 টাকা রোজগারের জন্যে এই পরিশ্রম! লেখাপড়া, সমস্ত বিসর্জন দিয়ে এইভাবে জীবন যাপন!
পরেরদিন, চিনপাই স্টেশনে আবার ঐ শ্যামল বাবুর সঙ্গে দেখা! শ্যামল বাবু সেদিনের মত রিটার্ন টিকিট দিয়ে অনিকেত আর বিজয়কে বললেন, আপনাদের তো মোটামুটি দুবরাজপুরে 3 মাসের পোস্টিং। আমি লোক পাঠিয়ে পাণ্ডবেশ্বর থেকে সাইঁথিয়া পর্যন্ত তিনমাসের টিকিট কাটিয়ে আনছি। সন্ধ্যেবেলায় যখন ফিরবেন, তখন নিয়ে নেবেন। অনিকেত টাকা দিতে গিয়েছিলো। শ্যামল বাবু হাসতে হাসতে বলেছিলেন- গেজেটেড অফিসার 15 টাকা মেরে দিয়েছে, এই অপবাদ দেবার সুযোগ আমি ছেড়ে দেবো ভেবেছেন?
এরপর আর কথা চলে না! অনিকেতরা সেদিন একই ভাবে ট্রেনে ফিরছিলো। সবাই ছিলো। এমন সময় ট্রেনে এক সৌম্যদর্শন টিকিট চেকারের আবির্ভাব!

১১/৭/২০২৪

শর্মাজীর হাসি

শেষ পর্ব
卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐

চিনপাই স্টেশনে অনিকেতের সঙ্গে উনিও নামলেন। শ্যামল বাবু প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েই ছিলেন। শর্মাজী ওনাকে দেখে একগাল হেসে বললেন- দাদাs আপনার পাড়ার লোককে পৌঁছে দিয়ে গেলাম!
শ্যামলবাবুও একবার অনিকেত আর একবার শর্মাজীর মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে সৌজন্যমূলক ভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, ও পরিচয় তাহলে হয়ে গেছে! তা সাহেব, বসতে পেয়েছিলেন তো?
শর্মাজী আবারও হাসতে হাসতে ট্রেনে উঠে বললেন- সেটা সাহেবকেই জিজ্ঞাসা করে নেবেন- এখন আসছি!
এরপর থেকে একটা ঘটনা ঘটলো! প্রায় সমস্ত স্টাফই মান্থলি টিকিট কেটে ফেললো! অনিকেত আর  বিজয়ের মান্থলি টিকিট তো শ্যামল বাবুই কিনে রেখেছিলেন।
তো এরপর বহুবার কি সাইথিয়া থেকে বাড়ি থেকে ফেরার সময়ে, কিংবা পাণ্ডবেশ্বর থেকে সিনেমা দেখে ফেরার সময় শর্মাজীর সঙ্গে অনিকেতের দেখা হয়েছিলো। প্রতিবারই হাসি আর পাশে বসে খোশগল্প! একদিনের জন্যেও আর টিকিট দেখতে চান নি। শুধু অনিকেত আর বিজয়ের নয়, কোনো স্টাফদের টিকিটই দেখতে চান নি। সেলিম আর নিখিল বলেছিলো- আপনি আমাদের টিকিট দেখতে চাইছেন না তো? কেন? শর্মাজী  হেসে বলেছিলেন, যেদিন টিকিট কাটবেন না, সেদিন  আমি ঠিক চাইবো, দেখে নেবেন।
এটাই একদিন সত্যি হলো, আর সেটাই অনিকেতের কাছে চিরবিস্ময়কর হয়ে রইলো !
দেখতে দেখতে তিন মাস কেটে গেলো। অনিকেতদের যে যার হল্কা ক্যাম্পে পোস্টিং হয়ে গেলো,  সেটেলমেন্টের ভাষায়, কেবির কাজ করার জন্যে! সে আর এক পর্ব, তার কাহিনী আর এক দিন শোনানো যাবে।   
ঐ অন্ডাল সাইথিয়া লোকালে যাওয়া আসা করলেই অনিকেতের সঙ্গে ঐ শর্মাজীর দেখা হয়ই। কোন হকারের ডালপুরি ভালো, কার কাছে ভালো মশলা মুড়ি পাওয়া যায়, কার শশা অন্যদের থেকে বেশি কচি, সেসব শর্মাজীর মুখস্থ! আস্তে আস্তে ওনার থেকে শিখে অনিকেতেরও বেশ ভালোই রপ্ত হয়ে গিয়েছিলো।
শুধু তাই নয়, কোন ছোকরা 10 পয়সাতেই ভালো সু পালিশ করতে পারে, কে 5 পয়সায় ভালো চা শুধু দেয় না, ভাঁড়ের চা ফুরিয়ে গেলে আর একবার পুরো বিনাপযসায় রিফিল করে দেয়, সেইসব খবর ছিলো শর্মাজীর কাছে জলভাত!
শর্মাজী শুধু  নিজেই খাদ্যরসিক ছিলেন না, অপরকে খাওয়াতেও ভালো বাসতেন।
এরমধ্যে অনিকেত প্রায়ই এসে দুবরাজপুরের মেসে এসে থাকে। দুবরাজপুরে এলে অনিকেত আর ইদ্রিস একসঙ্গে এক তক্তপোশে থাকে। ওরা যেন হরিহর আত্মা! অনিকেত আর ইদ্রিসের বন্ধুত্বের কাহিনী নিয়েই মনে হয় একটি গোটা বই লেখা যেতে পারে। সে যাই হোক,  দুবরাজপুরের কানুনগো মেস সত্যি যেন  আনন্দ সম্মেলন। তাপস, ইদ্রিস, অশোক দত্ত, অশোক মুখার্জী, উদয়ন গাঙ্গুলী, তপন ঘোষ, প্রবীর সেন, পিনাকী , ভানু চ্যাটার্জি, বাদল বসু, ভবানী সামন্ত , আদিনাথ ভাদুড়ি, সত্য আচার্য - সে একেবারে হই হই  রই রই অবস্থা! প্রতিদিন সন্ধ্যায় প্রবীর সেনের দুর্দান্ত রবীন্দ্র সঙ্গীত, তপন গুহর কণ্ঠে মান্না দের আর শ্যামল মিত্রের গান, আর পার্বতীর গলায় অসাধারণ সব ভক্তিগীতি, আর বাউল গান,  উদয়ন আর সত্যের যোগ্য সঙ্গত সহযোগে তবলা,  আদির চুটকি, উদয়নের সেই চুটকির জবাব- দুবরাজপুরের মেশের হ্যারিকেনের আলোকে পুরো হ্যালোজেনের আলোতে নিয়ে চলে যেতো।
ও হ্যাঁ, বলা হয় নি, আরো দুজন গায়ক ছিলো দুবরাজপুর মেসে- তাপস চক্রবর্তী আর স্বপন ঘোষ- তাপস চোখ বন্ধ করে শ্যামাসঙ্গীত, আর স্বপন চোখ খুলে ওপর দিকে তাকিয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতো! মেসের অন্য ছেলেরা বলতো, পার্বতী, তপনের গান শোনার পর মা যাও বা এদিকে আসবেন আসবেন করছিলেন, তাপসের গান শোনার পর, মা আর দুবরাজপুরের দিকে পা ফেলবেন না! আর স্বপনের রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনার পর, ওরা বলতো, স্বপনের গান শুনে পঙ্কজ মল্লিক আর শান্তিদেব ঘোষ আত্মহত্যা না করেন!
ভবানী ছিলো এক কাঠি সরেস! সবসময় কানে রেডিও লাগিয়ে থাকতো, আর বিভিন্ন স্টেশন ধরার বৃথা চেষ্টা করতো। ভবানী একদিন স্বপনের গান শুনে বলেছিলো- এই একটু আস্তে, খবরে বলছে- দেবব্রত বিশ্বাসের হাঁপানির টান একটু বেড়েছে, খুব কষ্ট পাচ্ছেন উনি! ডাক্তারেরা বলেছেন- এখন দুবরাজপুর, বোলপুর , শান্তিনিকেতন না যেতে!
প্রসঙ্গত একটা কথা জানিয়ে রাখা ভালো, স্বপন ঘোষের এক বোন কিন্তু অসাধারণ রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন। শিবপুর বি ই কলেজের যে কোনো অনুষ্ঠানে ওনার সঙ্গীত পরিবেশন ছিলো এক নিয়মিত ঘটনা! কলেজের অনেক ছাত্রীই তাঁর নিয়মিত গানের ছাত্রী ছিলেন।
আর একজন গায়ক ছিলো দুবরাজপুরে! সে নীহার! প্রচণ্ড নস্যি নিত। নাক সম্পূর্ণ বোজা! হাতে নস্যির টিপ ধরে রেখে, চোখ বন্ধ করে নজরুল গীতি গাইতো সে! প্রথম টা নজরুলের বাণী থাকলেও পরের দিকে নিজের বাণী, নিজের সুর সে অনায়াসে চালিয়ে দিতো। বলতো এগুলো নাকি নজরুল সুর দিতে পারেন নি, শুধু কমল দাশগুপ্ত নয়, ওকেও নাকি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো। ও নেহাত এই কানুনগোর চাকরি করতে চলে এসেছে বলে  স্টুডিওতে যেতে পারছে না। এখন এই দুবরাজপুর মেসে এসে সুর দিয়ে শুনিয়ে সবাইকে ধন্য করছে!
তো এই পরিবেশের মধ্যে গরমের ছুটিতে অনেকের বাড়ি থেকে তাদের ভাই বোনেরা, মায়েরা, দিদিরা এসে হাজির হলেন। দুবরাজপুর মেস যেন আনন্দনগর হয়ে গেলো!
ঠিক হলো একদিন সবাই মিলে তারাপীঠ যাওয়া হবে। সকালবেলা ঐ অন্ডাল সাইথিয়া লোকালে সাইথিয়া গিয়ে ওখান থেকে মজফফরপুর ফাস্ট প্যাসেঞ্জার ধরে রামপুরহাট যাওয়া, ওখান থেকে রিক্সা করে তারাপীঠ।
সেদিন ছিলো শনিবার। সবাই তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে তৈরি হতে হতেই বেশ দেরি হয়ে গেলো! স্টেশনে যাবার রাস্তাটা শর্টকাট করার জন্যে অনিকেতরা সবাই মিলে সোজা মাঠ ভেঙে স্টেশনের দিকে জোরে এগুতে আরম্ভ করলো। দূর থেকে দেখলো ট্রেন চলে আসছে। অন্যদিন ভালোই লেট করে, সেদিনে যেন আগেই চলে এসেছে। স্টেশনের প্রায় সামনে এসে ট্রেন যখন আওয়াজ দিচ্ছে, তখন অনিকেতরা প্রায় সবাই হাত দেখিয়ে ছুটে ছুটে এসে কোনোরকমে ট্রেনে উঠে পড়লো।
অনিকেত বুঝে গেলো, তার কাছে মান্থলি টিকিট থাকলেও বাকি আর কারো কাছে টিকিট নেই।
সবাই বসে বসে গল্প আরম্ভ করলে কি হবে, অনিকেত উসখুস উসখুস করছে,  মনে মনে চাইছে, টিকিট চেকার শর্মাজী যেন চলে আসেন, তাহলে আর কোনো চিন্তা থাকবে না।
তো সিউড়ি স্টেশনেই শর্মাজী এলেন। এসেই সেই একগাল হাসি।
--আরে সাহেব, কোথায় যাবেন, মনে হয় তারাপীঠ?
অনিকেত একটু অবাক হয়েই বললো- কি করে বুঝলেন?
-- বুঝলাম বাড়ি থেকে সব মাসীমা, দিদিরা, দাদারা, বোনেরা এসেছেন, এই ট্রেনে যাচ্ছেন, সাইথিয়া থেকে তো মজফফরপুরে ফাস্ট প্যাসেঞ্জার ধরবেন?
অনিকেত কিছু না বলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।
তারপরই এক কাণ্ড করলেন শর্মাজী। সেই পরিচিত ডালপুরি ওয়ালা উঠেছিলো, উনি বললেন- সবাইকে 4 টে করে ডালপুরি দাও। মাসীমারা দুজন, আর তিন দিদিরা পুজো দেবেন, তাই উপোস করেছিলেন। তাঁরা বাদ দিয়ে প্রায় চোদ্দ পনেরো জনকে উনি ডালপুরি খাওয়ালেন। অনিকেত আর উনি পাশাপাশি বসেই খেলেন। শর্মাজী বললেন, আপনি চিন্তা করবেন না, সাইঁথিয়ায় ঐ ট্রেন, এই ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করবে। আপনারা ভালো ভাবে পৌঁছে যাবেন।
আরো কত গল্প অনিকেতের সঙ্গে। দেখতে দেখতে সাইথিয়া এসে গেলো। অনিকেত ভাবলো বাঁচলাম।
ঠিক স্টেশনের আগে, শর্মাজী হাসতে হাসতে অনিকেতকে বললেন- সাহেব, আজ আপনি কারো টিকিট কাটেন নি, তাই তো? আর আপনার মান্থলিও দেখুন শেষ হয়ে গেছে। আমি দিদি ভাইদের আর মাসীমাদের ঐ ট্রেনে ভালো ভাবে বসিয়ে দিচ্ছি, আপনি ধীরে সুস্থে যান, সবাইয়ের রামপুরহাটের টিকিট কেটে আনুন, গেটে কেউ কিছু বলবে না।
অনিকেত স্থাণুর মত কিছুক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে রইলো।
শর্মাজী বাকি সবাইকে নিয়ে যাবার সময় হাত নাড়তে নাড়তে, হাসতে হাসতে বললেন- আরে সাহেব, দাঁড়িয়ে থাকবেন না, যান,তাড়াতাড়ি টিকিট কেটে আসুন, এই ট্রেনে আমি কিন্তু থাকবো না!
অনিকেতও হেসে হাত নাড়লো, মুখে অস্ফুট স্বরে বললো-  সাবাস শর্মাজী!

*****
সমাপ্ত।

অনুপ কুমার মুখার্জী
মোবাইল নম্বর: 9831111205

এই গল্পের ৯০ শতাংশ সত্যি। নিছক আনন্দ দেবার জন্যে কিছু কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়েছে। কাউকে ব্যক্তিগত ভাবে ছোট করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে এই লেখকের নেই। তবুও যদি কেউ এই লেখার জন্যে কোনো আঘাত পান, তাঁর কাছে আমি নি:শর্ত ক্ষমাপ্রার্থী!!
আর যদি এই লেখা পড়ে কেউ কেউ আনন্দ পান, তার কৃতিত্বও কিন্তু ঐ সব চরিত্রদের!
লেখকে কোনোভাবেই কোন কৃতিত্ব দাবী করতে পারেন না!
🙏❤🙏

১০/০৭/২০২৪

সংযোগসূত্র সার্ভে টিম

ফিল্ড ইন্সট্রাক্টরঃ বৈদ্যনাথ সেনগুপ্ত

ফিল্ডবুক রাইটারঃ সমীর ভট্টাচার্য

ফিল্ড সুপারভাইজারঃ রামচন্দ্র ঘোষ ও আশীষ সরকার

bottom of page