সংযোগসূত্র
আর জি কর কান্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে দ্রুত প্রতিকার চাইছি
অপূর্ব দাশগুপ্ত
কেজিও বিষ্ণু
তখনো ‘রেভিনিউ অফিসার’ শব্দবন্ধটুকু আসতে আরো বছর দুয়েক লাগবে, সে বছর পুরুলিয়ায় কেজিওদের ট্রেনিং শুরু হয়ে গেছে। জানুয়ারি মাস, প্রবল শীত। এই ঠান্ডায় ভোর ভোর আমাদের মাঠে গিয়ে চেন ফেন টেনে জমি মাপতে হয়। নকশা বানাতে হয়। দুপুরবেলায় আবার রস-কসহীন আইনের ক্লাস। শুধু রবিবার আমাদের খুশি,আমাদের ছুটি।
সেদিন ‘হিল ভিউ’ গেস্ট হাউসের বারান্দায় আমরা রোদে বসে আড্ডা মারি। দুপুরে হাই রোডের ধাবায় গিয়ে জমিয়ে মাংস দিয়ে ভাত খাই, মাঝেমাঝেই সন্ধ্যায় সিনেমা হলে হিন্দি সিনেমা দেখে ফিরে, খেয়ে দেয়ে শুতে গিয়ে মনে পড়ে, কাল আবার সকাল সকাল ওঠা আছে।
একদিন,ছুটিরদিনে সকালে আমরা আড্ডা মারছিলাম গেস্টহাউসের সামনে বসে, দেখি তিনি আসছেন। বিষ্ণুপদ নস্কর। আমাদের ব্যাচের শেষ ট্রেনি।
শুনেছিলাম সে ক্যানিং থেকে রাইটার্স বিল্ডিং দিব্য যাতায়াত করছে। কনিষ্ঠ কেরানি ফিসারি বিভাগে। জয়েন করবে না এই ঝকমরির অফিসার তকমা আটা ঝামেলায়। কিন্তু এখন সে এসে গেছে।
তার আসা দেখেই আমাদের হয়ে গেছে। পা দুটি তার ধনুকের মত বাঁকা। দু পা ইনসুয়িং করে গোড়ালিতে মিলেছে। আর সেই মিলনস্থলে কেডস জুতো আর তার অগ্রভাগ কি করে যে নাগরাই ধরনের চটির মাথার আকার নিয়েছে, সে এক রহস্য। তার কাঁধে সবুজ রঙের এয়ার ইন্ডিয়া লেখা ব্যাগ, চেন কাটা। হাতে হোলডোল। হেলদোল নেই কোন। এখানেই থাকবে বোঝা যায়।
আমাদের চন্দনের ঘর ফাঁকা ছিলো। সে সৌখিন ছেলে। পারফিউম মাখে। সে বিষ্ণুকে ঘরে নিতে চায় না তার ছিরি দেখে।শেষে বিস্তর চাপাচাপির পর সে রাজি হয়ে বলে, আমার খাট থেকে ৩০ লিঙ্ক দূরে খাট পাততে হবে ওকে। ব্যাপারটা মজার মনে হলেও আমাদের রক্তের মধ্যে যে একটা তাচ্ছিল্য বোধ খেলা করেছিল তা সেদিন অন্তত আমরা টের পাই নি।
চন্দন দিন কয়েক বিষ্ণুকে নিয়ে নানা আপত্তি তুলেছিলl -- মশারি তোলে না মাইরি সারাদিনে। রাত্রে মশারি তুলে বিছানায় ঢুকে পড়ে ফের। মশারির চেহারা দেখেছিস তোরা। লাইফে কাঁচেনা।
আমাদের স্বঘোষিত নেতা তুষার বিষ্ণুকে ধরে। বলে, মশারি তুলিস না কেন? কাচিস না কেন?
বিষ্ণু হাসলে ওর চোখ ছোট হয়ে পড়ে, কালো মুখখানি ঝলমলে দেখায় অতি শুভ্র দন্তরাশির বিকাশে। ভুবন ভোলানো হাসিতে আমাদের অর্ধেক কাত করে সে বলে, মাইরি মশারির অরজিনাল রংটাই ঘোলাটে। আর মশারি টাঙিয়ে রাখলে চন্দনের কোথায় আসলে অসুবিধা জানিস তোরা?
কি অসুবিধা?
ও এদিকের দেয়ালে একটা অশিষ্ট ছবি টাঙিয়েছিল, এখন আমার মশারির ঠেলায় সেটা আড়াল হয়েছে।
চন্দন এবার ওকে তাড়া করে, ধরতো ধরতো বলে ধাওয়া করে।
কিন্ত কিছুদিন কাটতে না কাটতেই।বিষ্ণুকে ছাড়া আমাদের দিন কাটে না। এমন সরল সে! এমন মজার।
একদিন পুরুলিয়া শহরে টহল দিয়ে সন্ধ্যায় কুলায় ফিরে আমাদের খবর দিল, বাংলা জেরক্স বেড়িযে গেছে মাইরি, দেখে এলাম।
সে বাড়ি গেলে আমাদের মন খারাপ। তার বাড়ি যাবার কারণগুলিও অদ্ভূত। মেয়ের অসুখ শুনে একবার সে বাড়ি গেলো। সে ফিরতে আমরা তাকে বলি, মেয়ে কেমন আছেরে ?
সে মেয়ের মায়ের ঘাড়ে দোষ চাপায়। আরে সকাল বেলায় তেল মাখিয়ে বাচ্চাটাকে রোদে রেখেছিল, আচারের বয়মগুলির পাশে। কিরকম দায়িত্ব জ্ঞান ভাব, বয়মগুলি তুলেছে, মেয়েটা সারাবেলা পরেই রয়েছে ঠাঠা রোদে। সারাদিন রোদে সেঁকে মেয়ে যায় যায়।
বিষ্ণু আমাকে অনেক গোপন তথ্য জানাতো। যেমন, চার্জ অফিসার আমাদের বিজয় কে এতো বাড়িতে ডাকে কেন। অসিত কোয়ার্টারের মাঠে এতো ফুটবল নিয়ে কেরামতি দেখায় কাকে। এছাড়াও তার সহধর্মিনীর নানা মজার কান্ড সে আমায় বলতো। এমন কি বউকে লেখা চিঠি ও তার প্রত্যুত্তর সে আমাকে দেখাত।
তখন নানা রকমের সরকারি ক্ষমতা আমাদের নামে আসতো। একবার এরকম এক পাওয়ারের চিঠি এসেছে। বিষ্ণু খুব গর্ব করে বউকে লিখল, “শুনিয়া খুশি হইবে যে পশ্চিমবঙ্গের মাননীয় গভর্নর আমাকে ইন্ডিয়ান এভিডেন্স এক্ট এর ৭৬ নং ধারার পাওয়ার দিয়াছে।”
আমি বলি এইভাবে সরল বৌটির কাছে তুই হিরো হোস, তাই না।l
বিষ্ণু চোখ ছোট করে হাসে।
কিন্তু এ চিঠির উত্তরে ওর বউ এক শক্তিশালী বোমা ফাটায়।
আইনের ক্লাসের বিরতিতে বিষ্ণু আমাকে আড়ালে টেনে বউ এর চিঠি দেখায়। বৌয়ের লেখা একটা ইনল্যান্ড মেলে ধরে। তাতে নানা সাংসারিক কথাবার্তার পর লিখেছে বিষ্ণুর বউ - ‘শতকোটি প্রণামন্তে নিবেদন এই যে শুনিয়া সুখী হইলাম যে মাননীয় গভর্নর আপনাকে ৭৬ নং পাওয়ার দিয়াছে, কিন্তু ইহাতে আপনার মাহিনা কত বাড়িল তাহা তো লেখেন নাই।’
ট্রেনিং শেষ হবার পর সে অন্য জেলায় চলে গেল। নানা জেলা থেকে তার অভিনব সব খবর পাই। তার কথা শেষ করবো এবার। এগল্প শুনেছিলাম অলোকের কাছে থেকে। অলোককে ADM ম্যাডাম একদিন ডেকে বললেন, আপনাদের বিষ্ণু রোজ আমাকে sms করে, তাতে কিছু বার্তা থাকে না, ব্ল্যান্ক, ফাঁকা। ব্যাপার টা আপনারা দেখুন প্রথমে, পরে আমি দেখছি। বিষ্ণুকে ধরা হল। সে বলে, কী করবো মাইরি, প্রথমেই ফোনে ADM লেখা , তাই ফোন নাড়াচাড়া করতে গেলেই, প্রথমেই ওনার নামে sms চলে যায়। বলতে বলতে কী করে ব্যাপারটা ঘটে সে ফোন বের করে প্রাকটিক্যাল দেখাতে যায় এবং চেঁচিয়ে ওঠে, যা: আরেকটা sms ম্যাডামের ফোনে চলে গেল। এবার অলক ADM ডিলিট করে ম্যাডামের নামটি ফোনে তুলে দিয়েছিল। ওনার নামের অদ্যাক্ষর ভাগ্যক্রমে A দিয়ে ছিলো না।

চাকরিতে যোগদান ১. ১. ১৯৮৭
পুরুলিয়া।
অবসর ৩০. ১১. ২০১৭.
দক্ষিণ ২৪ পরগনা ভূমি অধিগ্রহণ দপ্তর