top of page

অমিত কুমার বসুর কানুনগো কথা

amit basu.jpg

২৯/৬/২৪

আজ  শুরু করি প্রথম চাকরীতে যোগদানের, ০১/৪/১৯৭৪,  দিনের অভিজ্ঞতা থেকে । চলবে কিনা সবাই ঠিক করবে।

 

হাতে ছোট বোর্ডের  সুটকেশ এবং হোল্ডলসহ মেদিনীপুর মেস থেকে বেরিয়ে গড়বেতাগামী বাসে চেপে শালবনীর আগে সুন্দরা বাস স্টপেজে নামলাম, সংগে তরুন মুখার্জী । তরুনের বাসস্টপেজের  একটু আগে রাস্তার উপর সার্কেল অফিসেই ওর হল্কাক্যাম্প আর আমার ক্যাম্পটি বাস স্টপ থেকে 2 কিমি ভিতরে লেংটিসোল যাবার রাস্তায়। বি ক্যাম্প থেকে দেওয়া রুট ম্যাপে তেমনি দেখলাম। ঠাঠা রোদ্দুরে বেডিং কাঁধে, হাতে সুটকেশ ঝুলিয়ে হল্কার উদ্দ্যেশ্যে হাঁটতে শুরু করলাম জনমানবহীন  রাস্তার দুপাশে দিগন্ত বিস্তৃত ধানজমির মাঝ দিয়ে।

 

অবশেষে দুএকজন  মাঠে কর্মরত চাষীকে জিজ্ঞাসা করে ঘর্মাক্ত কলেবরে সুবর্ণ ঘোষের রেশন দোকানে এ উপস্থিত হয়ে বি ক্যাম্প অফিসারের চিঠি দোকান মালিককে দিলাম ও নিজের পরিচয় দিলাম। রেশন দোকান কাম মুদিখানাটি হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল ।একটি হাতল-ভাঙ্গা চেয়ার কাঁধের গামছা দিয়ে মুছে বসতে দিলেন এবং একজনকে সরবত দেবার আদেশ করলেন। দোকানটি একটি মাটির দোতলা, দোকানের মধ্যে এক পাশ দিয়ে দোতলায় ওঠার সিড়ি । সুবর্ণবাবু জানালেন দোতলাটা হল্কাক্যাম্পের জন্য ঠিক করা হয়েছে। আর আমার থাকার ব্যবস্থা দোকানের পিছনে ওদের বাখুলের বাইরে একটি পাকা ঘর আছে সেখানে (আমি থাকতে পারি), তবে ওনার ছোট ছেলে রাতে আমার ঘরে শোবে। খাওয়াদাওয়া ওর বাড়িতেই হবে, যখন যেমন জুটবে। থাকা খাওয়া বাবদ ৫০ টাকা মাসে দিতে হবে। কথাবার্তা চলছে ইতিমধ্যে বারদুয়েক জল চেয়েছি, আর সুবর্ণবাবু সরবত দেবার হুঙ্কার শুনেছি, সরবত আর আসে না। ইতিমধ্যে দোতলায় উঠে দেখি আমি দোতলার ঘরে সোজা হয়ে দাড়াতেই পারি না এত নীচু।  ঘরে ছোট দুটি জানলা আছে ,খুলে দিলে রোদ আসে হাওয়া আসেনা । মুহুর্তের মধ্যে আবার ঘেমে স্নান করে গেলাম।

নীচে নেমে দেখি আমার সরবত তৈরী হচ্ছে । একটি এলুমিনিয়ামের ঘটিতে সামনের  কুয়া(অটোফ্ল) থেকে জল নিয়ে জং-ধরা ছুরি দিয়ে লেবু কেটে বড় বড় নখওয়ালা আঙ্গুল দিয়ে চিপে, এক হাতা চিনি বস্তা থেকে নিয়ে দুই আঙ্গুলে চিমটি দিয়ে বস্তা থেকে নুন ঘটিতে ফেলে সরবত তৈরী হল ছুরি দিয়ে জল নাড়িয়ে। এবার প্রায় অস্বচ্ছ মোটা কাচের গ্লাসে সরবত  ঢালতে যাচ্ছে, সুবর্ণবাবু ছুটে এসে কাঁধের গামছা গ্লাসের মুখে পাতলেন 

সরবত ছেঁকে গ্লাসটি আমার হাতে বিনীতভাবে দিলেন পান করার জন্য।

         আমার তখন গলার ভিতর ঘামতে শুরুকরেছে।।

 

৩০/৬/২৪

২য় পর্ব

নেংটিশোলের ঐ রাস্তার শেষ প্রান্তে বাংলা কংগ্রেস এম এল এ অমূল্য মাহাতোর বাড়ি। সেখানে আমরা তিন কানুভাই মিলে একমাস পরে থাকতে শুরু করি। একমাস সুন্দরাতে ছিলাম ঘোষেদের বাড়ি।

             তখনও কোন কর্মচারী আসেনি, চেয়ার, টেবিলও নেই।গ্রামের মধ্যে কোন পায়খানা নেই, মাঠে যেতে হয় । পাজামা পরে মাঠে গিয়ে কোন আড়াল না পেয়ে ফিরে আসি। স্নানের জায়গাটি ভাল এবং আর্টেজিও কূপে জল মাটির উপরে থাকায় খুব সহজে ভালভাবে স্নানকরে  সার্কেল অফিসে গিয়ে কাউকে না পেয়ে বাস ধরে মেদিনীপুর সদর বি-ক্যাম্পে। পায়খানাবিহীন এমন বাজে জায়গায় থাকা যাবে না । মেদিনীপুর থেকে যাতায়াত করব। বি-ক্যাম্পের ওসি জানালেন কাজ শুরু হলে যাতায়াত করা সম্ভব হবে না, আর মেদিনীপুর গ্রামাঞ্চলে ৯৯% বাড়িতেই পায়খানা নেই। উপদেশ দিলেন লুঙ্গী ব্যবহার করতে এবং কিভাবে মাঠে প্রাতঃকৃত্য করতে হয় সেটা দেখিয়ে2 দিলেন। সন্ধ্যার অন্ধকারে মাঠে যেতে বারণ করলেন, না হলে, সাপ-বিছার কামড খেতে হবে। অগত্যা লুঙ্গী কিনে সন্ধ্যার মুখে সুন্দরা ফিরে এলাম। রাতে ঐ বাড়ির ছেলেটির সাথে আলোচনা করে জানলাম রেলপথের দিকে লোকজন বিশেষ থাকে না তবে ঐ দিকে কোন জলের সোর্স নেই । বালতি করে জল নিয়ে যেতে হবে। অগত্যা জল নিয়ে মাঠে যাওয়াই ঠিক করলাম। রেল লাইনের ধারে গিয়ে দেখি 4' ডায়া-র সিমেন্টের কয়েকটি পাইপ পড়ে আছে । চমৎকার ওর ভেতর ঢুকে আড়ালে প্রাতঃকৃত্য সারতে কোন বাধা নেই। দিন সাতেক এইভাবে কাজ সারছি । এরমধ্য লক্ষ্য করেছি পাইপের ভিতর বর্জ্য নেই, কে যেন পরিষ্কার করে দিচ্ছে। পরে আবিষ্কার করি কয়েকটি শূকর আমার পাইপের ভিতর ঢুকবার অপেক্ষায় থাকে এবং ওরাই পরিষ্কার করে দেয়।

            এরমধ্য লেংটিশোলের অফিসার তাপস সেন এবং আরও একজন সোমনাথ ব্যানার্জ্জীর সাথে পরিচয় হল এবং ঠিক হল তিনজনই অমূল্যবাবুর বাড়িতে মাসে 60 টাকার বিনিময়ে পেয়িং গেষ্ট হিসাবে পরের মাস থেকে থাকব। অমূল্যবাবুর বাড়িতে একটি পায়খানা আছে, গেষ্টদের ব্যবহারের জন্য। দিন দশেক পর তরুনকে জানিয়ে, কোন সার্কেল অফিসার না থাকায়, বাড়ি ফিরলাম । বাড়িতে ফিরে দেখি রেলের ট্রাফিক ইনস্পেকটরের পরীক্ষায় পাশ করেছি, জয়েন করবার আমন্ত্রনপত্র এসেছে, DRM শিয়ালদাতে জয়েন করতে হবে। কানুনগো এবং ইনস্পেক্টর এর স্কেল বোধ হয় এক ছিল। মুক্তির আনন্দ নিয়ে  দাদাকে জিজ্ঞাসা করতে দাদা , এককথায় নাকচ করে দিলেন, বল্লেন Kgo থেকে ছয় সাত বছরে প্রমোশন হয়ে bcs হওয়া যায় আর রেল বড় সংস্থা সেখানে প্রমোশনের সুযোগ কম। মন খারাপ করে মেদিনীপুর ফিরলাম। এর দুদিন পর বিকালের দিকে বাস রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়েছি, হঠাৎ কালবৈশাখী ঝড় চারিদিক অন্ধকার সংগে বৃষ্টি। ঝড়ের হাত থেকে বাঁচতে আশ্রয় নিলাম রাস্তার কালভার্টের নিচে। ঝড়বৃষ্টি থামলে কালভার্টের নিচ থেকে বেরিয়ে এসে দেখি চারিদিক নিকষ কালো অন্ধকার কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সুন্দরার দিকে হাঁটতে হাঁটতে  বুঝতে পারলাম পথ হারিয়েছি। অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে দূরে রাস্তার উল্টোদিকে টিমটিমে আলো জ্বলতে দেখে ঐ দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে অবশেষে পৌছালাম এক ঝুপড়ি ঘরের সামনে। ডাকাডাকি করতে লম্ফহাতে একজন দেখা দিল। পরিচয় দিয়ে সুন্দরা ক্যাম্পে পৌছাতে সাহায্য করতে পারবে কিনা জিজ্ঞাসা করতে ও জানাল সুন্দরা অনেক দুর, রাতে যেতে পারবে না। তখন উপায় না দেখে ওর আশ্রয় চাইতে ও ঘর থেকে এক বস্তা বের করে দিয়ে বলল বারান্দাতে থাকতে পারি । অনন্যোপায় হয়ে বারান্দাতেই বসলাম, হঠাৎ ঘাড়ের কাছে ফচফচ আওয়াজে বুঝলাম আমার রাতের সঙ্গী এক ছাগল। সারারাত ওখানে বসে নিজের ভাগ্যের কথা চিন্তা করত করতে সিদ্ধান্ত নিলাম, পরেরবদিনই কোলকাতা ফিরে রেলে যোগদান করব। ভোর হতেই দরজা খুলে গৃহী বাইরে এল। দেখি একজন আদিবাসী, আর তালপাতা, খড় ইত্যাদি ছাওয়া ওর কুঁড়ে ঘর । 

"বাবু চল সুন্দরার পথ চিনাই।"

 ও আমাকে বাসরাস্তায় উঠিয়ে সুন্দরা যাবার পথ দেখিয়ে দিল। রাতে ঘরে জায়গা দিতে পারেনি কারন ওর বউ ঝড়জলের ঠিক আগেই ঘরেই ছেলের জন্মভদিয়েছে, ঘরে আর জায়গা নেই। ওর ছল ছল চোখে বারে বারে  ক্ষমা চাওয়া, সঠিক আপ্যায়ন না করতে পারার জন্য আমার মনে  সারারাত ধরে জমা গ্লানি নিমেষে দুর করে দিল, আমি সিদ্ধান্ত নিলাম রেলে  চাকরী করব না। এদের সাথেই থাকব।

এরপর আমার চাকরীজীবনে ঘোরা

মেদিনীপুর ,চব্বিশ পরগনা, হাওড়া,পুরুলিয়া, নদিয়া র একটি করে সত্য কাহিনী বলার ইচ্ছা রইল,

 

০২/০৭/২৪

 

৩য় পর্ব।

লেংটিশোলে তাপস সোমনাথের সংগে একসাথে থাকতে চলে এলাম। মাসের তৃতীয় সপ্তাহেই ছোট একটি ঘটনার সম্মুখীন হলাম। একদিন লক্ষ্য করলাম ফ্রকপরা রোগা টিনটিনে একটি মেয়ে দুপুরের খাবার পরিবশন করছে। খাওয়ার পর বাড়ির কর্তা এসে জানতে চাইলেন মেয়েটি কেমন দেখলাম। পছন্দ হলে বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে এগুতে চান। পত্রপাঠ নাকচ করে দিয়ে জানালাম, আমি অমূল্যবাবুর বাড়িতে আজ এখুনি শিফট করছি। আপনাকে দেয় টাকাটা নিয়ে আমাকে যেতে দিন, পারলে আমার বেডিং এবং সুটকেশটি অমূল্যবাবুর বাড়িতে পৌছাতে সাহায্য করুন। ভ দ্রলোক অবাক হয়ে বারবার মিনতি করলেন থেকে যাবার জন্য, অবশেষে তার এক বাগালকে দিয়ে আমার বেডিং ও সুটকেশ অমূল্য বাবুর বাড়িতে পৌছে দিয়েছিলেন। 

 

লেংটিশোলে আমরা খুব আনন্দে ছিলাম। ইতিমধ্যে কাছাকাছি সব হল্কা অফিসারদের সাথে পরিচয় হয়েছে। রতনমাণিক সরকার, সুজিত দাস  (পরে ব্যাঙ্কে চলে যায়), অনিল ব্যানার্জী (পরে bcs হয়), পার্থসারথী স্যান্যাল তলাপাত্র (পরে bcs ), একসাথে গ্রামের ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলা, পরিত্যক্ত এয়ারপোর্টের ভিতরদিয়ে সন্ধ্যার সময় যেতে গিয়ে সুজিতকে কাঁকড়া বিছা কামডানো ও হসপিটালে নিয়ে যাওয়া, অমূল্যবাবুর সাথে এয়ারস্ট্রিপের ঝোপে বুনো খরগোশ শিকার করা, মাহাতো-পল্লীর অতি সাধারন জীবনযাপনের (এরা প্রকৃতপক্ষে ট্রাইবাল  জীবন যাপনে ও সংস্কৃতিতে) সাথে পরিচিত হওয়া, তাপস সেনের(পরে ব্যাঙ্কে চলে যায়) বিখ্যাত কবিদের কবিতা আবৃতি ও মনন , দিনগুলি ছিল যে সোনার খাঁচায়। এখানেই ঘটল আমার জীবনের এক রোমহর্ষক ঘটনা।

 

সেদিন রাতে ছোটবাথরুমের তাড়নায়  বাইরে বেরিয়ে সামনে কঞ্চিবাশের ঝাড় দিয়ে ঘেরা উঠানের একপাশে বাঁশঝাড়ের নীচে বাথরুম করছি। সামনে তাকিয়ে দেখি একফালি চাঁদের আলোতে দিগন্ত বিস্তৃত ধুসর অন্ধকারে ছাওয়া মাঠ । নিস্তব্ধ চরাচর। হঠাৎ দেখি দূরে দপ্ করে জ্বলে ওঠা আগুনের শিখা। আরে, এতো মিথেন গ্যাসের আগুন জ্বলা, পরক্ষণেই মন পড়ল ওদিকটাতো এয়ারস্ট্রিপ, শুকনো এবং কংক্রিটের জঙ্গল । জলা জমি নয়। মিথেনগ্যাস হতে পারে না। এই ভাবনার মধ্যেই আগুনের শিখা জ্বলতে-নিবতে জ্বলতে-নিবতে  ক্রমশঃ আমার দিকে এগিয়ে আসছে দেখছি। আমি স্থানুবৎ দাড়িয়ে আছি। এবার আগুন জ্বলতেই দেখলাম, যেন এক নারীমূর্তির মাথায় আগুন জ্বলছে নিবছে এবং আমার দিকে আসছে। ভাবনাহীন ভাবেই এক ইঁটের টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে অপেক্ষা করছি নিঃশব্দে। মূর্তিটি এগিয়ে এলে দপ করে জ্বলা আগুনের শিখায় স্পষ্ট হল এক উলঙ্গ এলায়িত চুলের নারীমূর্তি। আমি বাঁশঝাড়ের নীচে অন্ধকারে থাকায় আমাকে লক্ষ্য করা সম্ভব ছিল না। মূর্তিটি আমার আট নয় ফুট দুরত্ব দিয়ে গ্রামে ঢুকবার পথে উপর পৌঁছে আবার তার মাথায় আগুন জ্বলে উঠতেই আমি হাতের ঢিল সজোরে মূর্তি লক্ষ্য করে ছুঁড়তেই, ধপ করে আওয়াজ এবং হি হি হি  করে ভয়ঙ্কর গলায় পৈচাশিক হাসি দিয়ে ও গ্রামের ভিতর ছুটে চলে গেল। আমি চোর চোর বলে চিৎকার করতে লাগলাম ,আওয়াজ বেরুল চোঁ চোঁ চোঁ ,,,,।গলা ভয়ে শুকনো কাঠ হয়ে গেছে।

 

প্রায় সংগে সংগে অমল্যবাবুর দোতলার জানালা খুলে গেল, আর অমূল্যবাবুর সাবধানবানী -কেউ কোথাও বেরুবেন না , নড়বেন না । বন্দুকের ফায়ারিঙ এর আওয়াজ। একটু পরে অমূল্যবাবু বাখুল থেকে বেরিয়ে বাঁশতলা থেকে আমাকে ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

৩/৭/২৪

 

৩য়  পর্বের শেষাংশ

আমাকে ধাক্কা মেরে ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেওয়াতে একটূ অপমনিত বোধ করলাম। তখন ঘরে অপর দুই বন্ধু গভীর ঘুমে । ধীরে ধীরে আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরী হল। রাতের কথা মনে করতে করতে দেখি দরজা খোলা।  বাইরে বন্ধুরা এবং অমূল্যবাবু চেয়ারে বসে । উঠানে দশ-বারোজন অপরিচিত গ্রাম্য মানুষ। গামছা নিয়ে ইন্দারার দিকে এগুতেই অমূল্যবাবুর নির্দেশে ওদের এক বাগাল ইন্দারা থেকে জল তুলে বড়ো বাথরুমের ব্যবস্থা করে দিল। বাথরুম সেরে অন্যান্য দিনের মত দাঁত মেঁজে স্নানের নির্দিষ্ট জায়গায় বসে পড়লাম। বাগালটি ইন্দারা থেকে জল তুলে ধীরে ধীরে আমার মাথায় ঢেলে স্নান করিয়ে দিতে লাগল।বশিবের মাথায় জল দিলে শিব খুব সন্তুষ্ট হন জানি। এইভাবে স্নান না করলে কেউ বুঝতে পারবেন না কি আরাম ও তৃপ্তি হয় এভাবে স্নান করলে । স্নানের তৃপ্তি নিয়ে ঘরে ফিরে এলাম। এরমধ্যে আমি লক্ষ্য করেছি বারান্দা ও উঠানে থাকা সব মানুষেরা আমাকে সারাক্ষণ লক্ষ্য করছেন। আমি জামাপ্যান্ট পরে বাইরে এসে খালি চেয়ারে বসতেই অমূল্য বাবু উঠানে বসা এক ব্যাক্তিকে দেখিয়ে বল্লেন উনি ওনাদের সমাজের প্রধান গুনিন। গতরাতের ঘটনা জানিয়ে ওঁকে ডেকে এনেছেন, আমি যেন ওর সাথে একটু কথা বলি। দেখলাম নির্দিষ্ট ব্যক্তিটির মাথায় ফেটি বাঁধা এবং মাথার পিছনে পালক গোঁজা।কানে হাড়ের দুল। তিনি আমার কাছে এসে গত রাতের ঘটনা জানতে চাইলেন । আমি সব বল্লাম। এরমধ্যে ওর ইঙ্গিতে বাখুল থেকে এক গ্লাস হলুদ রঙের দুধ এনে ওর হাতে দিল এক জন। ওঝা দুধটা আমাকে খেয়ে নিতে বল্লেন , অমূল্যবাবুও খেতে বল্লেন। এরপর উনি জিজ্ঞাসা করলেন বাড়িতে দুটো বড় কুকুর আছে, পাড়াতেও অনেক কুকুর আছে, শেষ রাতে মাঠে শেয়াল ডাকে, এদের কোন ডাকাডাকি আমি গতকাল রাতে শুনতে পেয়েছিলাম কিনা? আমি না বলতে, উনি জানালেন বাড়ির কেউই ঘটনার সময় জেগে ছিল না , একমাত্র অমূল্যবাবুকে বিশেষ বন্ধন দেওয়া আছে , ফলে ওরা মানে ডাইনেরা অমূল্যবাবুকে ঘুম পাড়াতে পারে না। এর পর উনি বল্লেন গতকাল বিশেষ যোগ ছিল , এমন দিনে বার গ্রামের ডাইনরা একসাথে নানা তন্ত্রক্রিয়াতে যুক্ত হয়। এই গ্রামেও একজন ডাইনী আছেন , কিন্তু তিনি কে কেউই জানে না। এই ডাইনীরা এইসব বিশেষ  দিনে গ্রামের  মানুষ সহ সব প্রানীদের ঘুম পাড়িয়ে ডাইন সম্মেলনে যায় । সবাই ঘুমিয়ে থাকে ওরা  নিজ ডেরায় না ফেরা পর্য্যন্ত। আমার ক্ষেত্রে ওর প্রভাব না পড়ার কারন আমার বিছানা এবং অমুল্যবাবু বিছানা উপর নীচ একই তলে অবস্থিত এবং খাটটিও অমূল্যবাবুর ব্যবহৃত(পরে জেনেছি এটা ঠিক কথা)। যাইহোক দুধখাওয়া ও অন্যান্য কথা বলতে বলতে আধা ঘন্টা পেরিয়েছে, এবার ওঝাবাবু বল্লেন আপনার ভয় নেই। ডাইন অন্ধকারে আপনাকে দেখতে পায় নি , আর ওর তন্ত্রযন্ত্র আমার মারা ঢিলে ভেঙ্গে যাওয়ায় ও নাকি হীনবল হয়ে দৌড়ে ওর আস্তানাতে ফিরে যায়।

 

এবার আমরা সবাই রাস্তায় ভাঙ্গা যন্ত্র দেখতে গেলাম । দেখি একটি বড়  ঝুল কালী ও সিন্দুর মাখান মালসা ভেঙ্গে পড়ে আছে । চারিদিকে তুষ এবং ধুনো ও সাদা সাদা কিছুর গুঁড়ো । শুকিয়ে যাওয়া জবার ছোট মালা এবং একটি মাগুর মাছ।ছোট্ট একটি বাঁকানো ছুরি। 

 

ওঝা ওর সাকরেদদের কিছু নির্দেশ দিয়ে রাস্তাটি পরিষ্কার করতে বলে দিল। আমরা ফিরে আসতে অমূল্যবাবু টিফিন আনবার জন্য বলে দিলেন। আমি শুধু বলেছিলাম অমূল্যবাবু যেন সবার জন্য টিফিনের ব্যবস্থা করেন। সে দিন সবার জন্য লুচী আলুর তরকারী ও শুকনো লঙ্কা এল। ওঝা যাবার আগে আমাকে কয়েকদিনের জন্য লেংটিশোল ছেড়ে যেতে বল্লেন , আর আমার হাতে একটি শিকড় বেঁধে দিয়ে গেলেন । আমি গ্রামের মান্যবরকে ২ টাকা দিয়ে জোড়হাতে  নমস্কার করলে অনেক অনেক আশীর্বাদ করলেন।

ওরা চলে যাবার পর  বিকাল বেলায় অমূল্যবাবুর এক বাগাল সাইকেলের পিছনে চাপিয়ে আমাকে শালবনীতে রতন মানিক ও শচীন সরকারের মেসে পৌছে দিল । আর আমি কখন লেংটিশোল যাই  নি।

বর্তমান বাসস্থানঃ নিউটাউন

চাকরিতে যোগাদানঃ ০১/০৪/১৯৭৪ মেদিনীপুর

অবসরঃ৩১/০৩/২০১২ ডি এম ডি সি, বারাসাত কালেক্টরেট

মোবাইল নং ৭০৪৪৩১৭৫৪১

সংযোগসূত্র সার্ভে টিম

ফিল্ড ইন্সট্রাক্টরঃ বৈদ্যনাথ সেনগুপ্ত

ফিল্ডবুক রাইটারঃ সমীর ভট্টাচার্য

ফিল্ড সুপারভাইজারঃ রামচন্দ্র ঘোষ ও আশীষ সরকার

bottom of page