সংযোগসূত্র
আর জি কর কান্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে দ্রুত প্রতিকার চাইছি
অরুণাভ পণ্ডা
বাসস্থানঃ মানিকাবসান, রামনগর, পূঃ মেদিনীপুর
চাকরিতে যোগদানঃ ১৮/০২/১৯৯১
ওরগ্রাম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বর্ধমান
অবসরঃ ৩০/১১/২০১৯
অ্যাডিশনাল এল এ ও পশ্চিম মেদিনীপুর

-- ::আমার কথা::--
এটা আমার প্রথম চাকুরী, আসলে আমি এক অন্য পেশার লোক ,আমিই সম্ভবত প্রথম যে এই সার্ভিসে এসেছি অন্য এক পেশা (চিকিৎসা জগত)থেকে । আমার আগে আগে যারা লিখে গেছেন, স্মৃতিচারণ করেছেন তারা কিন্তু সকলেই গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে কাজ করেছেন, আমাদের যারা রাজস্ব আধিকারিক হিসেবে এই চাকরিতে প্রবেশ করেছি তাদের ঠিক সেই সৌভাগ্যটা হয়নি। ফলে সেই রোমাঞ্চকর অনুভূতিটা আমরা কিন্তু অতটা পাইনি। আমাদের ঝোলা খালি। আমি রাজস্ব আধিকারিক হিসেবে ১৯৯১ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারি জয়েন করি। আমি যখন ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষা দিই তখন কিন্তু আমি আমার নিজের পেশায় যথেষ্ট ভালো জায়গায় আছি। আমি গ্রামের মানুষ, আমি এখনো গ্রামে থাকি, ১৯৮৪ সালে বি এইচ এম এস পাস (আমরাই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাস্ট বিএইচএমএস ব্যাচ)করার পরে আমি প্র্যাকটিস শুরু করি সেই অঞ্চলে অর্থাৎ আমি যে অঞ্চলে থাকি বা আছি। প্র্যাক্টিস ভালোই চলছিল ,তখন তো এখনকার মত ইনস্টিটিউশনাল ডেলিভারি এত হত না , গ্রামাঞ্চলে ডেলিভারি বাড়িতে বাড়িতেই হত। আমার শিক্ষার সুবাদে ওইটাতে আমার ভালো হাত যশ ছিল ,তারপর আমায় ভূতে পেল,কি হল ১৯৮৮ সালে মন হল ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষা দিই, প্রচন্ড ব্যস্ততার মধ্যেও পরীক্ষা দিলাম, তৎকালীন প্র্যাকটিস বাদ দিয়ে পড়াশুনা করার ফুরসৎ খুব কম ছিল, বাইরে কোন সংস্থায় বা কোচিং সেন্টারে কোচ নেওয়া তো দূরের কথা ,আমার কিন্তু কোনকালে ইচ্ছে ছিল না চাকরিতে যাওয়া। পরীক্ষাটা খুব একটা ভালো হয়েছিল না, যাইহোক ১৯৮৯ সালে এপ্রিল মাসে আমাকে পার্সোনালিটি টেস্ট তে ডাকা হল, ১৯৯০ সালে এপ্রিল মাসে চিঠি এলো জয়েন করতে হবে মে মাসে। ওর গ্রাম বর্ধমান এর ট্রেনিং সেন্টার। আমার মাথায় বাজ পড়লো।তখন কিন্তু আমার নিজের প্র্যাকটিস ভালোই চলছে, ওই প্র্যাকটিস ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে আমার ছিল না। আমার বাড়ি রামনগর টু ব্লকে , একবার কি মনে হল রামনগর টু র বি এল এল আরও অফিসে গেলাম পরিচয় করতে কি চাকরি কত বেতন কেমন চাকরি কেমন প্রমোশন ইত্যাদি জানার জন্য ,দেখা করলাম দিলীপ ভট্টাচার্যের সাথে, লম্বা সুদর্শন গৌরবর্ণ এক ভদ্রলোক।তিনি তখন সেখানে RO হিসাবে পোস্টিং ছিলেন, সব শুনে তিনি বললেন তুমি একটু ভেবে দেখো, এটা সরকারি চাকুরী, জয়েন করা ভালো তবে পরেও জয়েন করতে পারো, তিনিও তার পূর্ব পেশার কথা বললেন, তিনি পূর্বে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ ছিলেন। এরপর বাড়ি চলে এসে কাউকে কিছু না বলে স্থির করলাম চাকুরীতে যাব না, যাব কি যাব না এইভাবে কয়েন টস করতে থাকতাম, অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার তো এসেই গেছে এবং দিলীপ দার বুদ্ধিমত একটা পিটিশন পাঠিয়ে দিলাম যে আমি অসুস্থ বলে। আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে সার্টিফিকেট এনে পাঠিয়ে দিলাম board of revenu তে। খবরটা বাড়ি কেউ জানলো না । কিন্তু আমাদের এই অঞ্চলে একটি লোক টাইপিস্ট এর কাজ করতেন board of revenue তে, ঘটনাচক্রে সে আমার appointment লেটারটাও টাইপ করেছিল, ও আমাকে না চিনলেও আমার বাবাকে খুব ভালো করে জানে, কিছুদিন পরেই ও বাড়িতে এসে আমাদের এক ফ্যামিলি ফ্রেন্ড মাস্টার মশাই কাকুকে কথায় কথায় বললেন অমুক বাবুর ছেলে ভালো একটা চাকরি পেয়ে গেল, ওই কাকু তো অবাক হয়ে গেলেন কারণ আমি তো তখন বাড়িতেই আছি। পরের দিন তিনি বাড়িতে এসে আমার বাবার সামনে আমাকে ডেকে যাচ্ছেতাই বকাবকি আরম্ভ করলেন, তখন আমি সত্যি কথাটা বললাম। এর পরের বছর 1991 সালে ফেব্রুয়ারিতে যখন চিঠিটা এলো সেই খবরটা উনি ওই টাইপিস্ট ভদ্রলোকের কাছ থেকে জোগাড় করে আমার বাড়িতে এসে হাজির, এবার আর কোন অজুহাত চলল না আমাকে ধরে বেঁধে ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ নিয়ে গেলেন সঙ্গে করে একেবারে orgram ট্রেনিং সেন্টারে ,তিনি নিজে গিয়ে ছেড়ে দিয়ে এলেন পাছে রাস্তায় নেমে আমি পালিয়ে আসি।।, এইখানে একটা দৃশ্যের কথা বলি আমি যখন খুব ভোরে আমার গ্রামের বাড়ি থেকে বের হয়ে বাস ধরার জন্য রামনগর যাচ্ছি তখন গ্রামের প্রচুর লোক বেরিয়ে আমার মাস্টারমশাইকে খুব বকাবকি করছে যে আমাকে জোর করে উনি চাকরিতে ঢোকাচ্ছেন বলে যেহেতু গ্রামের লোক ওই অঞ্চলের লোক আমার কাছ থেকে চিকিৎসা পরষেবাটা পেতো তাই তারা ভালোবেসে এই আটকাচ্ছিল, সে এক দেখার মত দৃশ্য সকলে আমার হাত ধরে টানাটানি 'তুমি যেও না তুমি যেওনা চাকরিতে ক পয়সা দেবে' ইত্যাদি আর মাস্টার মশাইকে তাড়া করছে।যাইহোক আমার ওই কাকু মাস্টার মশাই আমাকে নিয়ে গিয়ে বর্ধমানের ভাতারের ওরগ্রাম ট্রেনিং সেন্টারে ঢোকালেন বেলা দুটোর সময়, আমার চাকুরী জীবন শুরু হল, সেইখানেই পরপর সমস্ত বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় হলো । অবাক হয়ে দেখলাম আমার বাড়ির দু কিলোমিটার দূরে বাড়ি রাইটার্স বিল্ডিং ফেরত সত্য রঞ্জন মান্না সেখানেই তার সঙ্গে পরিচিতি হল।আমাদের ট্রেনিং সেন্টারে বিভিন্ন রুমের নাম আমরা বিভিন্ন দিয়েছিলাম যারা রাইটার্সের কাজ করেছিল এবং সেখান থেকে পরীক্ষা দিয়ে এসেছে সেই রুমটার নাম দিয়েছিলাম 'রাইটার্স বিল্ডিং' ,শিবাজী মুখার্জী বলে একজন ডিফেন্স একাউন্ট থেকে এসেছিলেন , শোয়ার সময় প্রচুর নাক ডাকতো তাই সে যে ঘরে থাকতো সেই ঘরের নাম ছিল 'বৃষভ নগর', সে নিয়ে শিবাজীর প্রচন্ড ক্ষোভ ছিল কিন্তু কে শোনে তার কথা,শ্রীকান্ত সাউর বাড়ি ছিল পটাশপুরের গোকুলপুরে তাই সে যে রুমে থাকতো সেই রুমের নাম হয়েছিল 'গোকুলনগর' যদিও সে এর আগে রাইটার্স বিল্ডিং এ চাকরি করতো, অনুরূপভাবে আমি যে ঘরে থাকতাম সেই ঘরের নাম হয়েছিল 'হসপিটাল' ইত্যাদি ইত্যাদি।এখানে উল্লেখ করি আমার রুমমেট ছিল সুদর্শন ব্রহ্মচারী (যে এখন রেভেনিউ সার্ভিসে চলে গেছে) অম্লান সেন (অনেক আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছে) এবং কমল সেনগুপ্ত,। এই ট্রেনিং সেন্টারের একটা ঘটনা বলি, আমাদের মধ্যে একজন ছিল ধরা যাক তিনি মধুসূদন (বলাবাহুল্য আসন নাম নয়) তাকে আমাদের সেন্টার ইনচার্জ কেশব দাস অনেক রকম আন ডিউ প্রিভিলেজ দিতেন অবশ্যই কারণ অজানা ,ও বাড়ি গেলেও ছুটি নিতে হতো না,দেরিতে এলেও মার্ক হতো না। অথচ আমি বা আমরা যদি বাড়িতে আসি উনি ছুটি দেবেন না, এ নিয়ে সকলেই অসন্তুষ্ট কিন্তু কেউ কিছু করতে পারছে না, একদিন করলাম কি সকালবেলায় প্রথমেই অফিসে গিয়ে দু একজন সই করার পরে দিলাম ঘচাং করে সমস্ত এটেনডেন্সে ক্রস আমারটা সহ, এই নিয়ে তোলপাড় চলল কে করেছে বলে, ট্রেনিং সেন্টারের ইনচার্জ পঙ্কজ দাস ডি এল আর ও সমীরন খদ্দর অনেক ফাঁস করলেন,কেউই কিছুই করতে পারলেন না শুধু হুমকি ছাড়া । সেই ঘটনার পর থেকে কিন্তু ঐ প্রিভিলেজ দেওয়া বন্ধ হয়ে গেল।ওইখানে দুই মাস থিউরিটিক্যাল ও প্র্যাকটিক্যাল ফিল্ড ট্রেনিং এর পরে আমাকে এবং আমার কয়েক বন্ধুকে দেয়া হলো মেদিনীপুরে পোস্টিং। তখন ডি এল আর ও দিলীপ চৌধুরী। তিনি একটা মিটিং ডেকে বললেন এদেরকে খড়্গপুর এ কে বি করতে পাঠাও। আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে বললাম যে না স্যার খড়্গপুরে কেবি আমরা করবো না , খড়্গপুর খুব বাজে জায়গা,আমাকে দেওয়া হোক মোহনপুরে। মোহনপুরের কথা শুনে ওনারা অবাক কারণ কেউ যেচে মোহনপুর নিতে চায় না, এই নিয়ে খুব উনাদের মধ্যে হাসাহাসি হল এবং আমাকে যাচাই করে নিলেন আমি মোহনপুর জানি কিনা। আসলে উনারা ভেবেছিলেন আমি মেদিনীপুরের সন্নিকটে মোহনপুরের কথা বলেছি ,সবশেষে স্থির হল আমি এবং আমার এক বন্ধুকে মোহনপুরে দেওয়া হলো, আসলে মোহনপুরে যাওয়ার মুরগী তো সহজে পাওয়া যায় না । মোহনপুর আমার বাড়ি থেকে 30 কিলোমিটার দূরে। আমি তখন বাড়ি থেকে যাতায়াত শুরু করলাম মোহনপুরে। বাইকে। মোহনপুরে থাকাকালীন অনেক ঘটনাই ঘটেছে, সব মনে নেই, আমি আর আই অফিসে বসে মজুরবেলি বলে একটি মৌজার ৫১ এ ওয়ান হিয়ারিং করছি, এনালগাস কেস ছিল তাই দু'ঘণ্টার মধ্যে আমি ত্রিশটা কেস করেছি। একচুয়ালি ওটা পাঁচটা কেস ছিল।হঠাৎ দিলীপ চৌধুরী inspection এসেছেন। এসে তিনি দেখলেন যে দু'ঘণ্টার মধ্যে ৩০ টা করা হয়েছে, ফিরে গিয়ে তিনি মেদিনীপুরে একটি সার্কুলার জারি করে দিলেন যে একজন ইউ টি আর ও যদি দু'ঘণ্টায় ৩০ টি কেস করতে পারে তাহলে একজন রেগুলার আর ও সারা দিনে অন্তত ৭০-৮০ টা কেস করবে। এই নিয়ে খুব টালবাহানা চলল। হেডকোয়ার্টারে বেতন নিতে গিয়ে আমাকে সকালে বকাবকি করল, বহুবিধ টিটকিরির সম্মুখীন হলাম। তার কিছুদিন পর আমাদের মত আর কয়েকজনের পোস্টিং হলো গোপীবল্লভপুর ফিফটি ওয়ান এ ওয়ান করার জন্য। নিজের বাঁশ নিজে নিলাম ,পড়লাম মহাবিপদে। শেষে অনেক বকুনি দেওয়ার পরে এন ডি এ (NDA) ডি এল এল আর কে এই অর্ডার থেকে নিবৃত্ত করালেন। অবশেষে দিলীপ চৌধুরী রাজভবনে চলে যাওয়ায় ১৯৯২ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি মোহনপুর থেকে রিলিজ নিয়ে চললাম পুরুলিয়ায় ১৯৯১ সালের জুন মাসের পোস্টিং অর্ডারের ভিত্তিতে। আক্ষরিক অর্থে এটাই আমার প্রথম পোস্টিং।
পুরুলিয়ায় গিয়ে আমি ডিএল আর ও ননী গোপাল চক্রবর্তী এর কাছে আবেদন করলাম আমাকে বান্দোয়ানে দেওয়ার জন্য। আসলে বান্দোয়ান চাওয়ার কারণ পাশের বাঁকুড়ার রাণীবাঁধ ব্লকের একটা স্কুলে আমার দিদি তখন শিক্ষকতা করে।সঙ্গে অরুন দে আর ভবানী দা, ওখানে যেহেতু আগে থেকে চারজন আছে তাই ডি এল আর ও দিতে চাইছিলেন না কিন্তু অরুণ দাও ছাড়ার পাত্র নয়।বান্দোয়ান ও মোহনপুরের মত জায়গা ওখানে কেউ যেতে চায় না, ফলে সহজেই আমি পেয়ে গেলাম যদিও আমার আগেই ওখানে চারজন আরো পোস্টিং আছে। যাই হোক আমার অর্ডার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দুজন আর ও বিভাস ভৌমিক ও মিলন কুন্ডু উঠে গেলেন ,তখন আমরা তিনজন RO হলাম আমি ,রাধা গোবিন্দ চক্রবর্তী এবং তুষার সৎপতি , BLRO ছিলেন শহিদুল ইসলাম। বর্ধমানের রায়না থেকে। তিনি আবার থাকতেন বান্দোয়ানের মসজিদ সংলগ্ন ঘরে,তাঁর সঙ্গে রাধা গোবিন্দ চক্রবর্তীর মঙ্গলবার এর কালীপুজো আর শুক্রবারের নামাজ পড়া নিয়ে প্রায় গন্ডগোল হতো ,তিনি শুক্রবারের নামাজ পড়ার জন্য বেলা একটায় অফিস থেকে চলে যেতেন, আর চক্রবর্তী মঙ্গলবার কালীপুজোর জন্য বেলা দুটোয় অফিসে আসতো, সে এক হাসির ব্যাপার, আমরা সবই উপভোগ করতাম। বান্দোয়ানের থাকাকালীন কুচিয়া SBI অফিসের ঝাড়ুদার চুনু সিং সরদার এর পুত্রবধূর পয়সার অভাবে চিকিৎসা না করতে পারার ব্যাপারটা আমাদের খুব কষ্ট দিয়েছিল। ওই ঝাড়ুদার চুনু সিং সর্দার ছিল বিগ রায়ত। আমাদের পূর্বে কোন এক অত্যুৎসাহী অফিসার রিটার্ন না দেওয়ার কারণে তার সমস্ত সম্পত্তি ভেস্ট করে দিয়েছিলেন, কোন রিটেনশন হয়নি এবং সবটাই বিলি হয়ে গেছিল কিন্তু তার পরিবর্তে তাকে কিছুই দেওয়া হয়নি এবং সে খেতে পেত না। আমরা চাঁদা করে দিতাম কিছু কিছু তাতে তার নিজের সংসার চলত, তখন এটা আমাদেরকে খুব মনে পীড়া দিয়েছিল। পরে জেনেছি চুনু সিং সর্দারের ওই পুত্রবধূ চিকিৎসার অভাবে মারা যায়। বান্দোয়ানের পোস্টিং থাকাকালীন আমরা কুইলাপাল বলে একটি জায়গার একটি আর আই অফিসে থাকতাম। নন ফাংশনিং অফিস ,সেখান থেকে ব্লকের দূরত্ব প্রায় ১৩/১৪ কিলোমিটার ,বাসেই যাতায়াত করতাম। কুইলাপালে থাকার সুবিধাটা ছিল এই কুইলাপালের অবস্থান মেদিনীপুর বাঁকুড়া এবং পুরুলিয়ার প্রায় সংযোগস্থলে ঝিলিমিলির কাছে, এখানে আমার রুমমেট ছিল তুষার সৎপথী এবং বীরভূম থেকে আসা বি এস স্বাধীন দে ।তখন প্রায়ই ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চা বন্ধ ডাকতো ,জেলাভিত্তিক ,ফলে যখন পুরুলিয়ায় বন্ধ ডেকেছে আমরা ঝিলিমিলি দিয়ে হেঁটে এসে বাঁশপাহাড়ীতে বাস ধরে চলে আসতাম, যখন বাঁকুড়ায় বন্ধ ডেকেছে তখন আমরা বনের ভেতর দিয়ে বাঁশপাহাড়িতে আসতাম। উল্লেখ্য বাঁশপাহাড়ীতে আমাদের এক বন্ধু মনোরঞ্জন পাত্রের বাড়ি। বস্তুত অবিভক্ত মেদিনীপুরের একদম দক্ষিণ প্রান্তে আমার বাড়ি এবং উত্তর প্রান্তে মনোরঞ্জন পাত্রের বাড়ি, এবং সেখান থেকেই 3-4 km দূরে আমাদের ডেরা।এভাবেই চলতো ।ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চা তখন প্রায় ই বন্ধ ডাকত। আমরা অবশ্যই এটা ভালো ভাবে ই উপভোগ করতাম। চুপি চুপি এখানে একটা কথা বলে রাখি কি বান্দোয়ান বিএলআর অফিস (যেটা এক বিগ রাতের ভেস্ট করা বাড়িতে ছিল) অথবা ভাড়া দেওয়া কুইলাপাল আর আই অফিস কোন অফিসেই বাথরুমের ব্যবস্থা ছিল না, ফলে আমরা সবাই ছিলাম 'মাঠমেহাগনেওয়ালা' । অথ অলমিতি বিস্তরেন ��।একবার অফিসে থাকাকালীন পেট খারাপ হওয়ায় ভীষণ অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়েছিলাম । অফিসে কোন মহিলা কর্মচারী ছিলেন না তাই বাঁচোয়া ।তখন বান্দোয়ান এ ইলেকট্রিসিটি ও আসেনি , ফোনের কথা তো দুর অস্ত। বান্দোয়ান এ বিএলআরও হিসেবে পেয়েছিলাম শহিদুল ইসলাম পরে সুজিত শীলকে। প্রায় চার বছর থাকার পরে ১৯৯৫ সালের নভেম্বর মাসে আমি পুরুলিয়া থেকে তমলুক (LR district since integrated set up) বদলি হই , তখন ডিএলআরও চন্দন সিনহা, খুব কড়া এবং খিটখিটে লোক, হেডকোয়াটারের ডিডিও রামদা (রাম রতন দাসে) র পরামর্শে আমি সঙ্গে সঙ্গে জয়েন করলাম না ,তিনি বললেন যে জয়েন করবে তাকে ভগবানপুরে পাঠানো হবে এইভাবে নোট শিট করা আছে। তাই আমি কয়েকদিন জয়েন না করে একটু কল কাঠি নাড়ালাম মেদিনীপুরের ডিএমকে দিয়ে, (তখন তমলুক ডিএলআর ও থাকলেও মেদিনীপুরের ডি এমের আন্ডারে থাকতেন, প্রশাসনিক ভাবে আলাদা জেলা হয়নি ) শেষ দিনে আমি জয়েন করলাম এবং আমার পোস্টিং হলো এগরা ওয়ানে বীরভূমের মানিক দাসের রিপ্লেসমেন্টে। এখানে বি এল আরও হিসেবে পেয়েছিলাম নদীয়ার চাকদার এক ভদ্রলোক (নামটা মনে নেই যিনি পরে পাঁশকুড়া ওয়ানে চলে গিয়েছিলেন)হাওড়ার অসিত রায় এবং দাঁতনের রবিন দাস,এখানেই প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর কাটানোর পরে আমার অর্ডার হলো এগরা টু তে। এপর্যন্ত এই দুটি ব্লক কাঁথি এস ডি এল রা ও আন্ডারে ছিল, তখন এসডিএল আর ও ছিলেন শ্যামাপদ আচার্য,বন্ধন দত্ত ,অমলেন্দু ভট্টাচার্য। ওখানে প্রায় এক বছর থাকার পরে এগরা এসডিএলআরও অফিসে ,(যেটা সবেমাত্র নতুন হয়েছে ) জুন ২০০২ এ জয়েন করলাম। এগরা SDLRO তে প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর কাটানোর পরে আমার চাকুরী জীবনের প্রায় ১৭ বছরের মাথায় ২০০৭ সালের ৭ ই ডিসেম্বর SRO II প্রমোশন হল এবং আমি অনেক টালবাহানার পরে মোহনপুরে বি এল আর ও হিসাবে জয়েন করলাম। এই সেই মোহনপুর যেখানে আমার ট্রেনিং পিরিয়ডের এক বছর কেটেছিল। মোহনপুরে বি এল আর ও হিসেবে প্রায় সাড়ে চার বছর এর কিছু বেশি কাটিয়েছি এবং মাঝে প্রায় এক বছর দাঁতন ওয়ানের বি এল এল আর ও র চার্জে ছিলাম। ওখানে প্রথম দিকে এসডিএলআরও খড়্গপুর হিসেবে পেয়েছিলাম অমর চ্যাটার্জিকে পরে আমারই ব্যাচমেট মৃধাঙ্ক ভূষণ মন্ডল কে। মোহনপুরে আমার tenure এর বছর তিনেক যাওয়ার পরে শেষের দিকে একটি বিগ রায়তের কেস ডি এল আর ও অ্যাপিলে মোটিভেটেড এবং বায়াস্ড রায় পাস করে প্রায় ডাইভেস্টিংয়ের অর্ডার দিয়েছিলেন। ভেস্টিং সেট অ্যাসাইড করে রিমান্ড ইয়ারিং এ পাঠিয়েছেন EA Act এর 6(1) প্রসিডিংস করার জন্য উইথ সাম স্পেসিফিক অবজারভেশন ,যেমন দেবত্তরকে পাবলিক ইন নেচার ধরতে হবে এবং তাকে সিলিং দিতে হবে , রায়ত এবং তার ছেলেদেরকে মিতাক্ষরা শাসিত হিসেবে গ্রাহ্য করতে হবে এবং সেপারেট রায়েত হিসাবে গ্রাহ্য করতে হবে, বেনামীতে রেকর্ডেড রায়ত কে তার সম্পত্তি বলে ধরতে হবে এবং বিগ রায়তের সম্পত্তি থেকে সেটা বাদ দিতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।এতে প্রায় ড্রাইভেস্টিং হতো ১৬২ একর, রায়ত খুব প্রভাবশালী লোক ছিলেন, রায়তের এক ছেলে অজয় মুখার্জির PA ছিলেন, তৎকালীন মেদিনীপুরের ডিএম সুরেন্দ্র গুপ্তার কলেজের মাস্টারমশাই ছিলেন এদের এক আত্মীয়। এই রায়তের এক ছেলের ছেলে ও বৌমা হাইকোর্টের নাম করা এডভোকেট। অফিসে ঢুকলেই ইংরেজির ফুলঝুরি ছুটতো, vestingএর পরিমাণ ছিল প্রায় দুশো একর। আমাদের এগেনস্টে প্রায় ৬৮ টা শুধু হাইকোর্টেই কেস ছিল,পাট্টাদার প্রায় ৭০০ জন ,আমার তো প্রায় দিশেহারা অবস্থা । ল অ্যান্ড ওড়ার সিচুয়েশন দেখার জন্য এসডিও অফিস থেকে প্রায়ই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আসতেন, এমন ও হয়েছে থানার আই সিকে প্রতিদিন রাত্রে এ গিয়ে বিগ রায়তের বাড়িতে হাজরান দিতে হতো হাইকোর্টের অর্ডারে।এদিকে তখন রাজ্যের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হবে হবে করছে, (পাশের পূর্ব মেদিনীপুরে পঞ্চায়েতি রাজ প্রশাসন তৎকালীন শাসকদল থেকে বেহাত হয়ে গিয়েছে ২০০৮ সালে) আর পাট্টা গুলো দেয়া হয়েছিল ১৯৯৯ /২০০০ সালে প্রায় এবং পাট্টাদাররা সকলেই দখলে আছে। বিগ রায়তের দুর্দান্ত প্রতাপশালী তিন নম্বর ছেলে প্রায় অফিসে এসে ধমকে যেতেন I will see you after 19 th may ( 2011) , বিভিন্ন এম এল এ এমপিকে দিয়ে আমাকে ফোন করানো হয়েছে,।এদিকে আমার EA Act এর কাজের অভিজ্ঞতা ও কম, মনোরঞ্জন পাত্র তখন ডিস্ট্রিক্ট ল সেলে আছে, সে সমস্ত ব্যাপারটা জানে তবুও হাত তুলে দিল। ডি এল আর ও শংকর হালদার কে মনোরঞ্জন এর উপস্থিতিতে সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলায় তিনি রিভিউ অ্যাপীল করার পরামর্শ দিলেন, যেদিন রিভিউ এপিল এডমিশন হবে সেই দিনই ডি এল আর ও আমাকে ডেকে বললেন ""ওই রিভিউ এপিল এডমিশন হবে না ,আপনি ওই এপিল জাজমেন্টের ভিত্তিতে ওইরেকর্ড কারেকশন করে দিন যেহেতু ভেস্টিং set aside করা হয়েছে ,আমার উপরেও ডিএম এর চাপ আছে না হলে আপনাকে সাস্পেনশনে যেতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি"।ফলে অবস্থা সহজেই অনুমেয়।সে সময় আমি আমার সিনিয়র আশীষ দার কাছে (আশিস সরকার ) দিনের পর দিন ছুটেছি এবং তার সহায়তায় প্রচুর খাটাখুটি করে একটি সিক্স ওয়ান প্রসিডি্ংস করলাম। ডাইভেস্টিংও আর করলাম না, বলা বাহুল্য রেকর্ড কারেকশন তো করা সম্ভবও নয় ,করিওনি ।ততদিনে এডিএম হয়েছেন অরিন্দম দত্ত । এর ফলশ্রুতিতে ক্ষিপ্ত হয়ে বিগ রায়তের ছেলে (যিনি তৎকালীন শাসকদলের ব্লক স্তরীয় নেতা ছিলেন ) এবং অন্যান্য লোকের দ্বারা মোটিভেটেড হয়ে আমাকে এ ডি এম ট্রান্সফার করে দিলেন মেদিনীপুর সদর এস ডি এল আর ও অফিসে, সেটা ছিল আগস্ট ২০১২, প্রথমে খুব কষ্ট হলেও ( কিছুদিন আগে আমার পিতৃ বিয়োগ হয়েছে এবং বাড়ি থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছিলাম বলে) ।পরে বুঝলাম ভালোই হলো, চললাম আশীষ দার কাছে। সদর মেদিনীপুরে আমার সেই প্রচন্ড খেটেখূটে তৈরি করা 6(1) proceeding অর্ডারটা এতই লিগেলি স্ট্রং ছিল যে শুনেছি এখনো এত বছর পরেও খুব বেশি সুবিধা করতে পারেনি ওই বিগ রায়েতের উত্তরসুরীরা। যাক আশীষ দার কাছে মেদিনীপুর সদর এস ডি এল আর ও তে এলাম।এই সময়টা আমার খুব ভালো কেটেছে একাডেমিকালি, আশীষদার সঙ্গে কাজ করা আনন্দের ব্যাপার, a very knowledgeable person. এক non biased উন্মুক্ত চিন্তা ধারার মানুষ ।তখনকার ডিএম দরকার হলে অর্থাৎ ল্যান্ড ম্যাটারে এক্সপাটাইজের দরকার হলে সমস্যায় পড়লে আশিস দা কে ডেকে পাঠাতেন। এখানে থাকাকালীনই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ হল তারকনাথ মন্ডলের সঙ্গে (আমার তারক দা)। সহকর্মী হিসেবে পাই ফাল্গুনীকে (ফাল্গুনী সতপথী) । ওইখানে আমাদের যুগলবন্দী খুবই ভালো ছিল। যাক এখানে প্রায় দেড় বছর কাটানোর পরে এরপর আবার ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে চললাম দাসপুর ওয়ান বিএলআর ও অফিসে সেই অরিন্দম দত্তের সৌজন্যে ।ওখানে সাত আট মাস থাকার সময় আগস্ট ২০১৪ তে আমার ডিসট্রিক্ট ট্রান্সফার হলো প্রায় সাত বছর পরে এবং চলে এলাম পূর্ব মেদিনীপুর জেলায়, এখানে এসে কাঁথিতে ডিডিও এবং ও সি এল আর পদে প্রায় চার বছর থাকা কালীন তিনবার প্রমোশন forgo (ব্যক্তিগত কারণে) করার পরে ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে আমি প্রমোশনে গেলাম আবার পশ্চিম মেদিনীপুরে ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন অফিসে Addl LAO হয়ে। বন্ধু হিসেবে পেলাম বীরভূমের খইরুল আনম, বাঁকুড়ার দেবব্রত চ্যাটার্জি ও তমলুকের মোজারদ হোসেন কে (এ এক পরম পাওয়া)। ওখানে প্রায় এক বছর তিন মাস থাকার পরে ২০১৯ এর নভেম্বরে চাকুরী থেকে বিদায় নিলাম।��
শুরু করলাম আমার নিজের পেশা যেখান থেকেই আমার উত্থান।
এই গেল আমার চাকুরীর পোস্টিং এর সালতালামি। এরপর যখন যেমন মনে পড়বে তখন স্মৃতিচারণ করব। ধন্যবাদ।
আমি অরুনাভ পন্ডা ARUNABHA PANDA
গ্রাম ও পোস্ট :মানিকাবসান MANIKABASAN
পিন ৭২১৪৫৩
রামনগর II
থানা রামনগর
sub-division কাঁথি
জেলা পূর্ব মেদিনীপুর
(এখনো এখানেই থাকি)
চাকরিতে যোগদান ১৮/২ /১৯৯১ RO হিসাবে
অবসর গ্রহণ করেছি ৩০/৯/২০১৯
পশ্চিম মেদিনীপুর Addl LAO হিসেবে
চাকুরীরত অবস্থায় বর্ধমান , পশ্চিম মেদিনীপুর ,পুরুলিয়া পূর্ব মেদিনীপুর ঘুরেছি
Mob: 9474615115