সংযোগসূত্র
আর জি কর কান্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে দ্রুত প্রতিকার চাইছি
আব্দুল মান্নানের
কানুনগো কথা
১/৭/২৪
২৪ নভেম্বর ১৯৭৩.
অন্ধকারের বুক চিরে ৪৩ - আপ দার্জিলিং মেইল ছুটে চলেছে। আমি ট্রেনে উঠেছি বীরভূমের নলহাটি স্টেশনে। সাধারণ বগিতে। বসার জায়গা পাইনি। ব্যাগে পুরোনো খবরের কাগজ ছিল। তারই একটা বের করে প্যাসেজে বসে গেলাম। এমনভাবে বসেছি প্যাসেজ দিয়ে যাতায়াতে কারো যেন অসুবিধা না হয়। পরনে পা'জামা। তাই গুছিয়ে বসতে অসুবিধা হল না। পেছনে হেলান দিয়ে ঘুমোনোর চেষ্টা করলাম। ঘুম কি সহজে আসে! তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে বাকি রাতটা যদি কাটিয়ে দিতে পারি!
বিহার সীমান্তে বীরভূমের এক অজ গাঁয়ের এক কাঠ বেকার তার চার বছরের বাউন্ডুলে জীবনের সমাপ্তি ঘটাতে চলেছে। পুরো চাকরি নয়। হাফ চাকরি! ট্রেনি কানুনগো।
স্কুল মাস্টারি করার সখ ছিল। জোটেনি। বলা ভালো জোটাতে পারিনি। 'কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে চায়।'
আগলা স্টেশন পাকুড়। তার পরের স্টেশন নিউ ফারাক্কা। ফারাক্কা ব্যারেজটা দেখতে পেলে মন্দ হয়না। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি!
ঘুম ভাঙ্গলো প্যাসেজ দিয়ে যাত্রীদের যাতায়াতের কারণে। চোখ খুলতেই দেখলাম যাত্রীদের কেউ কেউ দরজার দিকে যাচ্ছেন। কেউ আবার জানলার কাঁচ তুলে দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি নদীর উজানের দিকে জানলার পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ না পেয়ে ভাটির দিকে জানলার ধারে এসে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে এক প্রৌঢ় যাত্রী জানলার কাঁচ তুলে দিয়েছেন। আমি পাশে সিকি সিটে বসে খোলা জানালার দিকে তাকালাম। ট্রেন ব্রিজের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। গতি বেশ কম। জলাধার দেখার সুযোগ হল না। দেখতে পেলাম সড়ক ব্রিজ। ব্রিজের উপর পাহারারত নিরাপত্তারক্ষীদের দেখা গেল। ব্রিজ পেরোতে প্রায় চার মিনিট সময় লাগলো।
এবার পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে হবে। মেঝেতে পাতা খবরের কাগজে আমি যখন বসতে যাচ্ছি তখনই এক ভদ্র যাত্রী তাঁর সিটটায় আমাকে বসতে বলে উপরে উঠে গেলেন। আমি আমার ব্যাগটা ও শতরঞ্জি দিয়ে মোড়া লাইট বেডিংটা একবার দেখে নিয়ে সিটে বসলাম। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি!
এবার ঘুম ভাঙ্গলো ট্রেন আলুয়াবাড়ি রোড স্টেশনে পৌঁছানোর কিছু সময় আগে। এবারে ঘুম ভাঙ্গিয়েছে প্রকৃতি। সিটে বসার পর থেকে যাত্রীদের ধাক্কা আর খেতে হয়নি।
একমিনিটের কাজ সেরে প্যাসেজে দাঁড়িয়েছি। বিধ্বস্ত চেহারার এক যুবক আমার কাছে এসে দাঁড়ালো।
দুই উড- বি কানুর সাক্ষাৎ ও সংক্ষিপ্ত কথাবার্তা:-
যুবক(আমার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে): আপনি কোথায় যাবেন?
আমি:- জলপাইগুড়ি।
যুবক:- আপনার ওখানে বাড়ি?
আমি:- নাহ্ ।
যুবক: জলপাইগুড়ি আত্মীয়ের বাড়ি যাচ্ছেন?
আমি:- নাহ্ ।
কিছুক্ষণ নীরবতার পর।
যুবক:- আপনি ওখানে চাকরি করেন?
আমি: চাকরি করি না। তবে চাকরিতে জয়েন করতে যাচ্ছি।
যুবকের চোখে মুখে এক পরিতৃপ্তির ছাপ। যেন 'মিল গিয়া ভাব।'
যুবক:- কী চাকরি?
আমি:- ট্রেনি কানুনগো।
আনন্দে আপ্লুত হয়ে যুবক আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। জানালেন তাঁর নাম আনোয়ারুল হক*। তিনিও যাচ্ছেন ট্রেনি কানুনগোতে জয়েন করতে। আমি আমার নাম বললাম। আনোয়ারুলের কাছে জানলাম এই কামরায় আরো চারজন ট্রেনি কানুনগো আছে। সবাই রামপুরহাট স্টেশনে ট্রেনে উঠেছে।
কথা বলতে বলতে টের পাইনি কখন যে ট্রেন আলুয়াবাড়ি রোড স্টেশনে এসে থেমেছে । তারপর ছেড়েও দিয়েছে।
ট্রেন আবার থামলো। আলুয়াবাড়ি রোড স্টেশনের পর তো একেবারে নিউ জলপাইগুড়ি থামার কথা। হয়তো লাইন ক্লিয়ারেন্স পায়নি! দুজনে নেমে এলাম। ছোট্ট একটা স্টেশন। একটা চায়ের দোকানও রয়েছে। স্টেশনের বোর্ডের দিকে নামটা জানার চেষ্টা করলাম। নামটা জানার পর একটা বিশেষ অনুভূতি আমাকে নাড়িয়ে দিল।
এই সেই 'মাগুরজান।' চার বছর আগে একটা বিশেষ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে পড়েছিলাম: 'মাগুরজানের কৃষক রমণীরা সিআরপিএফ - এর কাঁধ থেকে রাইফেল ছিনিয়ে নিয়েছেন।'
ইঞ্জিনের বাঁশির শব্দ শুনে দুজনে ট্রেনে উঠলাম। ভোরের আলোয় দুদিক দেখা যাচ্ছে। দরজার কাছে প্যাসেজে দাঁড়িয়ে আমরা দুজনে। একসময় ট্রেন নিউজলপাইগুড়ি স্টেশনে এসে পৌঁছল।
ট্রেন থেকে নেমে প্লাটফর্মে দাঁড়ালাম। আনোয়ারুলের পরিচিত বাকি বন্ধুরাও নেমে এলো। সবার কাঁধে একটা করে বড় ব্যাগ। এক হাতে ধরা লাইট বেডিং। যে প্লাটফর্মে দার্জিলিং মেইল এসে দাঁড়ালো সেই প্লাটফর্মের আর একদিকে একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন দাঁড়িয়েছিল। ট্রেনের গার্ড সাহেবের কাছে জানতে পারলাম এই গাড়ি জলপাইগুড়ি স্টেশন হয়ে হলদিবাড়ি যাবে। ছাড়বে মিনিট পনের পরে। আমাদের টিকিট ছিল এন জে পি স্টেশন পর্যন্ত। আমি এক দীর্ঘ ফুট ওভার ব্রিজ পেরিয়ে স্টেশনের টিকিট কাউন্টার থেকে জলপাইগুড়ি যাওয়ার ছ'টা টিকিট কিনে নিয়ে এলাম। তখনও ট্রেন ছাড়ার সময় হয়নি। ট্রেনের কামরা প্রায় ফাঁকা। আমাদের বন্ধুরা তখনও কেউ ট্রেনে ওঠেনি। আমি টিকিট নিয়ে আসার পর সবাই মিলে ট্রেনে উঠলাম।
এক ঘন্টার মধ্যে ট্রেন এসে পৌঁছল জলপাইগুড়ি। আমরা নেমে এলাম। শুধু কি আমরা ছ'জন! আমাদের মতো কাঁধে ব্যাগ হাতে বেডিং নিয়ে একে একে যে স্টেশনের বাইরে চাতালে এসে পৌঁছলেন আরো বেশ কয়েকজন। সবাই কি একই চাকরিতে জয়েন করতে এসেছেন?
রিকশায় ওঠার আগে মোটামুটি জানা হয়ে গেল আমরা সবাই এক পথের পথিক।
আমি ও আনোয়ারুল এক রিকশায় উঠলাম। অচেনা অজানা শহর। রিকশা চালককে বললাম একটা মোটামুটি ভালো লজ বা হোটেলে আমাদের নিয়ে যেতে। চালক আমাদের পৌঁছে দিলেন 'রুবি বোর্ডিং'-এ। রিকশার ভাড়া মিটিয়ে আমরা আমরা বোর্ডিং - এ ঢুকলাম। তিনতলায় ডাবল-বেড - এর একটা ঘর পেলাম। বোর্ডিং - এর রেজিস্টারে নাম ঠিকানা লিখে সই করলাম দুজনেই। এক অল্পবয়সী কর্মচারী চাবি নিয়ে আমাদের রুমে নিয়ে এলেন। ওঁর কাছে ঘরের উত্তর দক্ষিণ জেনে নিলাম। উত্তরদিকে একটা জানলা ছিল। আমি সেই জানলাটা খুলেই যা দেখলাম তাতে এক অনির্বচনীয় আনন্দের ঢেউ আমার ওপর আছড়ে পড়ল। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। আমার অনুরোধে আনোয়ারুল জানলার কাছে এলো। বোর্ডিং - এর কর্মীও তখন আমার আনন্দের কারণটা বুঝতে পেরেছে। ওঁ তখন বেশ গর্বের সঙ্গে বললেন যে রুবি বোর্ডিং-এর উপরতলার ঘরগুলো থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা খুব পরিস্কার দেখা যায় বলে টুরিস্ট-রা
এখানে থাকা বেশি পছন্দ করেন।
হ্যাঁ। আমাদের সামনে পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা! সকালের সূর্যের সোনালী আলোয় উদ্ভাসিত কাঞ্চনজঙ্ঘার মোহময় রূপ দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল।
[ * সেদিনের সেই প্রথম সাক্ষাতের পর একান্ন বছর কেটে গেছে। আনোয়ারুল হক আর আমাদের মধ্যে নেই। কয়েক বছর আগে ও আমাদের ছেড়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে। তাই আজ যখন সেই প্রথম দেখা হওয়ার দিনের কথা লিখছি তখন বারবার ওর মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে]
