সংযোগসূত্র
আর জি কর কান্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে দ্রুত প্রতিকার চাইছি
আশীষ সরকার
২০/৭/২০২৪
তমসো মা জ্যোতির্গময়।
আশীষ সরকার
কর্মজীবনের স্মৃতি রোমন্থন করতে বসে প্রথমেই বলে রাখি আমার আখ্যান নেহাতই সাদামাটা। কোনো চমক নেই। সাদা কালো কাহিনীতেও টুইস্ট আনার জন্য যে মুন্সিয়ানা প্রয়োজন, আমার লেখনিতে তার ও অভাব।
মুর্শিদাবাদের ট্রেনিং সমাপনান্তে সেপ্টেম্বর ১৯৭৯সালে মেদিনীপুর কালেক্টরেট এ রিপোর্ট করলাম। কয়েকদিন অপেক্ষার পর ডেবরা এল আর সার্কেল অফিসে পোস্টিং হ'ল। অফিস বালিচক স্টেশন সংলগ্ন। বিডিও অফিস, সাব রেজিস্ট্রী অফিস ও জেএলআরও অফিস সব একই বিল্ডিং এ। অত্র দপ্তরে আমার প্রথম কর্মক্ষেত্র বালিচক/ডেবরা; এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই সেই অফিসের স্মৃতি বিশেষ প্রিয়। তবে সেই স্মৃতি পরে সুযোগ পেলে রোমন্থন করা যাবে।
১৯৮১সালের এপ্রিল মাস নাগাদ আমার স্হানচ্যূতি হ'ল খড়্গপুর-১ এল আর সার্কেল অফিসে। সেখানে যোগ দেওয়ার পরের দিন তৎকালীন এডিএম এলআর অর্ধেন্দু সেন( যিনি পরে মেদিনীপুর এর জেলা শাসক এবং যথাসময়ে রাজ্যের চিফ সেক্রেটারি হবেন) তাঁর দপ্তরে ডেকে পাঠালেন। তিনি বললেন, আশীষ আপনাকে এক বিশেষ উদ্দেশ্যে খড়্গপুর এ আনা হয়েছে। ওখানে প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও মাইনর মিনারেল খাতে রয়ালটি আদায় খুব কম। আপনাকে pilferage বন্ধ করে রয়ালটি আদায় কয়েক গুণ বাড়াতে হবে। উনি বলেই দিলেন গাড়ি পাওয়া যাবে না, তবে পুলিশের সাহায্য যাতে পাওয়া যায় সেই ব্যবস্থা করবেন। নিজের অফিসে ফিরে এসে দুই সার্কেল ইন্সপেক্টর (অনেকটা রেভিনিউ ইন্সপেক্টর দের পূর্বসুরী) এর সঙ্গে আলোচনা করলাম। দু'জনেই প্রবীণ। তাঁরা বয়স এবং তথাকথিত অনভিজ্ঞতার কারণে এই কাজে যুক্ত হতে অনিচ্ছা প্রকাশ করলেন। হাতে রইলো দু'জন আমিন বাবু। তাঁদের এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। সে কারণে আমার সঙ্গে তাঁরা যুতে গেলেন।
প্রথমে আমরা ইঁটভাটা এবং বালি খাদান গুলি সরেজমিনে দেখে কোনগুলি বেআইনী তা চিহ্নিত করলাম। এগুলির মালিক পক্ষকে বিডিও অফিসে ডাকা হ'ল; সেখানে বিডিও সাহেব, এসএলআরও,থানার বড়বাবু ইত্যাদির উপস্থিতিতে বেআইনি কার্যকর্তাদের থেকে মুচলেকা নেওয়া হ'ল যে তারা কোয়ারী পারমিট বিনা ব্যবসা করবে না। নির্দিষ্ট ফর্মে দরখাস্ত ঐ দিনই জমা নিয়ে নেওয়া হলো। উল্লেখ্য যে এক দুজন ছাড়া সবাই কিন্তু পারমিট তুলে ব্যবসা শুরু করেছিল। যারা ছিটকে গেল, পুলিশের হুজ্জুতে তারা রণে ভঙ্গ দিল।
কিন্তু আসল চ্যালেঞ্জটা ছিল মোরাম বোল্ডার নিয়ে। একটা পাকা রাস্তা পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে আইআইটি গোপালী সালুয়া কাঁথরা ডিমৌলীচক হয়ে ধবনীতে কালুয়াঘাই/ কেলেঘাই নদী পেরিয়ে কেশিয়াড়ীর দিকে চলে গিয়েছে। আর একটি রাস্তা এন এইচ সিক্স বা বোম্বাই রোড। খড়্গপুর কেশিয়াড়ী সড়ক এর উত্তর বরাবর এবং এন এইচ সিক্স এর দক্ষিণ পর্যন্ত বেশিরভাগ মৌজার ল্যাটেরাইট জমি খুঁড়লেই মোরাম আর কিছু কিছু জায়গায় ফুট খানেক নিচেই বোল্ডার। আমরা তিন নিধিরাম সর্দার, এই কথক, আর দুই আমিনবাবু পুষ্প পাত্র ও বিমল মাহাতো, তিনটি সাইকেল সওয়ারী হয়ে সপ্তাহে অন্তত চার দিন চল্লিশ পঞ্চাশ কিলোমিটার টহল দেওয়াটা ছিল আমাদের নিত্যকর্ম। উঁচু নীচু ডাহি জমি, রাস্তা প্রায়ই নেই, প্রাচীন গন্ডোয়ানাল্যান্ডের অংশ বিশেষ এই সব রুখাসুখা জমিতে একটু আড়াল খুঁজে পাঁচ সাতটি বা কোথাও পনেরো ষোলটি পর্যন্ত পুরুষ মানুষ খালি গায়ে মাথায় গামছা জড়িয়ে মাটি খুঁড়ে পাথর চাটান উন্মুক্ত করে তার ভিতর আট ন' ইঞ্চি ছেঁদা করে বারুদ ঠেসে ঠেসে ভরে সলতে লাগিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। একটা চাপা আওয়াজ হয় আর কিছুটা লাল ধুলো অল্প ধোঁয়া নিয়ে ছিটকে ওঠে। আমরা এরকম কিছু দেখলেই অকুস্থলে হাজির। পুষ্প পাত্র এই অফিসে কিছু আগে থেকে রয়েছে। সে অনেককেই চেনে। বিমল মাহাতো আমার সাথেই এখানে এসেছে। তবে তার স্বজাতির মানুষ এই পেশায় অনেকেই যুক্ত। এদের সহযোগীতায়, যদি শ্রমিকেরা ইতিমধ্যেই আমাদের দেখে দৌড়ে পালিয়ে গিয়ে না থাকে, খাদানটি কার বিনিয়োগে চালু হয়েছে জেনে নেওয়া যেত। বেশীরভাগ সময়েই মালিকটিকে ডেকে এনে শ্রমিক দের সামনে কড়ার করিয়ে নেওয়া যেত যে সে বিনা পারমিটে ব্যবসা চালাবে না। মুশকিল হতো যেখানে শ্রমিকরা পালিয়ে যেত বা মালিকটিকে সরেজমিনে আনা যেত না। পালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমরা শাবল গাঁইতি হাতুড়ি বারুদ ইত্যাদি সাইকেলে উঠিয়ে পঞ্চায়েত অফিসে জমা রাখতাম। যেহেতু উপকরণগুলো শ্রমিকদের নিজস্ব অর্থে কেনা, তাদের চাপেই মালিকটি অফিসে এসে যোগাযোগ করে কোয়ারি পারমিট তুলে নিত। যে সব ক্ষেত্রে মালিক পক্ষ ধরা দিতই না, সেখানে পুলিশের শরণাপন্ন হতে হতো। তাতে কাজ ও হতো। মোরাম বোল্ডার খাতে রয়ালটি আদায় এক বছরের মধ্যেই কিন্তু অনেক গুণ বেড়ে গেল। এডিএম সাহেব বছর শেষের মূল্যায়ন মিটিং এ বললেন ফেনোমেনাল ইমপ্রুভমেন্ট! ডি এম সাহেব বললেন এক্সেম্প্লারি অ্যাচিভমেন্ট!! এখন দেখি জেলা থেকে বিভিন্ন কাজে পারদর্শিতার কারণে বিএলআরও অফিস গুলিকে পদক ইত্যাদি দিয়ে পুরস্কৃত করা হচ্ছে। মনে হয় সেই সময়ে যদি এই প্রথা চালু থাকতো! আরও একটি কথা না বললে সত্যের অপলাপ হবে। এডিএম সাহেব যে বলে ছিলেন pilferage, তা ছিল নেহাতই ডিপ্লোম্যাটিক। যে পরিমাণ বেআইনি খাদান চালু ছিল তাকে বর্ণনা করতে হলে বলতে হয় wanton plunder. অবশ্য এটা শুধু খড়্গপুর নয়, সারা জেলায় ছিল এই চিত্র। প্রশাসন যখন গাঝাড়া দিয়ে উঠতো, তখন এই চিত্র কিছু পালটাতো। রয়ালটি খাতে রোজগার বাড়ানোর চিন্তা আশির দশকেই সরকারি স্তরে প্রাধান্য পায়।
আখ্যান ভাগের পরের অংশে আসা যাক। খড়্গপুর কেশিয়াড়ী রাজ্য সড়কে কালুয়াঘাই ব্রীজ এর কিছু আগে ডিমৌলীচক। ঐ চক থেকে দক্ষিণ দিকের মৌজা গুলিতে জমি উর্বর; তুলনায় সম্পন্ন গৃহস্থদের বসবাস। কোনো কোনো গ্রাম অতি প্রাচীন। (এই রাস্তায়ই এক সময়ে সুলতানি ও বাদশাহী আমলে সৈন্যবাহিনী ওড়িশা বা ঝাড়খণ্ডে যাতায়াত করতো বোঝা যায়। কোনও মৌজার নাম ঘোড়া বাঁধার চটি, কোনোটা আবার কসবা)। এই চকের উত্তরে রাস্তা বলে কিছু নেই। ডাহির ওপরে যাতায়াতে আপনা হতেই পথ তৈরি হয়ে গিয়েছে (স্হানীয় ভাষায় লীক্)। এই পথে মাইলটাক দূরে দু'টি গ্রাম, বাঁধগোড়া আর কেল্যাপ্রতাপপুর। বেশীরভাগ বাসিন্দা ই লোধা সম্প্রদায়ের। দু'পাঁচ ঘর অন্য সম্প্রদায়ের, বৈষ্ণব ইত্যাদি। যদিও ঐ লীক পথের পূর্ব দিক বরাবর অরণ্য বিভাগের প্রচুর জমি রয়েছে, প্রায় কোথাও বনের লেশমাত্র নেই। ধূ ধূ মাঠে দু'একটা রুগ্ন গরু ঘাস পালার খোঁজে ব্যর্থ ঘুরে মরছে। তাদের গলায় ঝুলানো কাঠের ঠরকা থেকে অদ্ভুত শব্দ বেরিয়ে পুরো দৃশ্যপটে কেমন একটা সুর রিয়েলিস্টিক মাত্রা যোগ করে! কিছু চারণরত ছাগল ও এই দৃশ্যপটের অংশীদার!
লোধা পুরুষদের চেহারায় আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। এরা সবাই প্রায় স্হানীয় বোল্ডার খাদানগুলিতে কাজ করে। আয়াসসাধ্য এই কাজের কারণে তারা সাধারণভাবে বলশালী, দেহ যদিও পেশীবহুল নয়। লোধা স্ত্রীলোকের চেহারা শ্রীহীন, ক্ষয়াটে; সাঁওতাল রমনীর থেকে একেবারেই পৃথক। এদের বসত বাড়িগুলিও শ্রীহীন। একটা বা দুটো কামরা, মাটির তৈরী, খড়ের চালের। সেই চাল ও পুরাতন, ঝরে পড়তে চায়। এক দু'জন, যারা বনবিভাগে বা ইরিগেশনে কোনো ভাবে জুড়ে গিয়েছে, এসবেসটাস বা টিনের চাল লাগিয়ে উঠেছে। সামনের উঠানে একটি বা দুটি চারপাই, তাতে দিনের সব সময়ই মেয়েরা বা বাচ্চারা শুয়ে থাকে। কারও কারও বাড়িতে একলা কেন্দ বা আকাশমনি গাছ উঠানে কিছুটা ছায়া দিয়ে রাখে। আব্রু বলতে উঠানের সামনের দিকে অযত্নে তৈরি জংলি গাছের বেড়া। প্রায় বাড়িতেই মুরগি ও দু'চারটি ছাগল রয়েছে। বেশীরভাগ দিনই ছাগলগুলো বাগাল ছেলে না আসার কারণে ঘরে বাঁধা পড়ে থেকে গতদিনের সবুজ ঘাস খাওয়ার স্মৃতি আর আগামী দিনের নতুন চারণভূমির সম্ভাবনায় বিভোর হয়ে থাকে। জলের নিজস্ব উৎস প্রায় বাড়ীতেই নেই। সর্বত্রই কেমন যেন অযত্ন ও দায়সারা গোছের ভাব। এদের কোনো জাতিগত পরিচয় সূচক পদবী নেই; দন্ডপাট, মল্লিক ইত্যাদি স্হানীয় ভাবে চালু পদবী ব্যবহার করে। তো এখানে আমার একটি পুত্রসন্তান লাভ হলো। ক্ষিতীশ দন্ডপাট, বছর ৩৭/৩৮, লোধা গৃহস্থ, একহারা চেহারা। সে বেআইনি বোল্ডার খাদানের মালিক, সাইকেল মিস্ত্রী, ট্রানজিস্টর সারাতে জানে, একটা বহু পুরাতন ঢরঢরিয়া মোপেড এর মালিক যেটা সে নিজেই চালু রেখেছে। তো এই লোকটিকে তার তিন চার জন শ্রমিক সহ আমরা একদিন ধরে ফেললাম। ক্ষিতীশ সামনে এগিয়ে এসে বললো আমি যে কোনোদিন তোমাদের আসার অপেক্ষায় ছিলাম। একশো টাকায় মাসে পঁচিশ টাকা সুদ গুণে রয়ালটি জমা করা আমার পক্ষে সম্ভব না। তুলে দিলে উঠে যাবো বটে কিন্তু আমার এই চারজন লেবার কাজ খোয়াবে। মরশুমের মাঝখানে তারা অন্য কোথাও কাজ পাবেনা। আমরা রাগারাগি করলাম, কারও পেট পালবার দায়, তাও বেআইনি কাজে, আমাদের নয় বলে ঘোষণা করলাম। ক্ষিতীশের ঠান্ডা মাথা; সে মৃদু স্বরে আবেদন রাখলো আমার কাছে, তুমি পারমিট তোলার টাকাটা আমাকে দাও; দুই আমিন বাবু আর লেবার তিন চার জনকে স্বাক্ষী রেখে বলছি ওটা ফেরত দেব। আমার কি মনে হ'ল, পরের দিন অফিসে দেখা করতে বলে ফিরে এলাম। পুষ্প পাত্র, আমিন বাবু, কড়ার করিয়ে নিলে যে পারমিট পাওয়া পর্যন্ত কাজ বন্ধ থাকবে। অফিসে ফিরে সবার সঙ্গে আলোচনা করলাম। প্রত্যেকেই বিবাহিত, সংসারী ও পার্থিব বিষয়ে সাবধানী। কেবলমাত্র দুই দিদিমনি করণিক এগিয়ে এসে বললেন মিনিমাম যে এমাউন্টটা লাগে আপনি দিয়ে দেখুন না স্যার; একান্তই ফেরত না পেলে আমরা দু'জন কিছুটা দায় বইবো। পরের দিন সকালে মেদিনীপুর গিয়ে এডিএম সাহেবকে জানালাম লোধা সম্প্রদায়ের একজন পারমিট তুলতে চায়, অল্প পরিমাণে। উনি যারপরনাই খুশি হলেন এবং দপ্তরে বলে দিলেন যতটা বেশি tenure দেওয়া যায় তার ব্যবস্থা করতে। ক্ষিতীশকে পাঁচশো টাকা দিয়েছিলাম। পারমিট পিরিয়ড শেষ হলে টাকা আদায় করে প্রতিবারই ও আমার টাকা ফেরত দিয়ে যেত। আবার কয়েক দিন পর সেটা নিয়ে নতুন পারমিট তুলতো। আমি ঐ অফিসে থাকার শেষ সময় পর্যন্ত এই এক্সারসাইজ জারি ছিল। ক্ষিতীশের কোয়ারী পারমিট তুলবার বার্তা ঐ অঞ্চলের বেআইনি ব্যবসায়ী দের কিছুটা নাড়িয়ে দিয়েছিল। তাদের অনেকেই এরপরে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ব্যবসা আইন মোতাবেক চালানোর উদ্যোগ নেয়। ক্ষিতীশের আমার সঙ্গে এই সহজ সম্পর্ক তৈরী হওয়ায় তার প্রতিবেশী, সহযোগী ও প্রতিযোগীরা ও তাকে আমার কাঠবেটা বলে ডাকতে থাকে। ক্ষিতীশ হয়তোবা এতে গর্বিত হতো। প্রকাশ্যেই সে আমাকে বাপ বলে সম্বোধন করতো। অফিসের দিদিমনিরা রহস্য করতেন যে ওনাদের ঘটকালিতেই নাকি আমার পুত্র লাভ হয়েছে!
এই ক্ষিতীশ পর্ব চলাকালীন তার প্রতিবেশী, লোধা সম্প্রদায়ের একজন মুরুব্বী আমাকে বলে যে, স্যার তোমার অফিসে আমাদের অনেক গুলো জমি ফেরত এর মামলা রয়েছে, ঐগুলো ফয়সালা করে দাও। আমি খোঁজ নিয়ে জানলাম ঐসময় প্রচলিত Restoration of Alienated Land Act,1973 মূলে তিরিশটি মতো দরখাস্ত কালেক্টর এর আদেশে আমার অফিস থেকে ফয়সালার জন্যে বৎসরাধিক আগে পাঠানো হয়েছিল। ফাইলে নোট দেখলাম আমার পূর্বসূরি সেগুলি দেখে আদেশ দিয়েছিলেন তাঁর উত্তরসূরির নিকট সেগুলি পেশ করতে হবে। যাইহোক, দরখাস্তগুলি সাজানোর পর দেখা গেল আঠারোটি হস্তান্তর ঐ মৌজা দুটির বিক্রেতারা একটি পরিবারের সদস্যদেরকেই করেছেন। সবকটি দলিলেই বিক্রেতারা নিজেদের জাতি পরিচয় দিয়েছেন মাহিষ্য এবং পেশা বর্ণনা করেছেন চাষাবাদ বলে। (এখানে উল্লেখ্য যে, জাতিগত পরিচয়ের কোনো সংশাপত্র এই মৌজাগুলির বাসিন্দাদের ছিল না। ব্যতিক্রম কেবলমাত্র সামান্য যে কয়েকজন চাকরি করতো আর এই মুরুব্বীটির মতোই এক দু'জন। শংসাপত্রের অভাবে অনেক সুযোগ হাতের বাইরে রয়ে যায় জেনেও কেবলমাত্র অফিস কাছারির হ্যাপা এড়াতে এদের এই শংসাপত্র সংগ্রহে ছিল অনিহা)। ক্রেতা পরিবার দাস পদবী ধারী, বৈষ্ণব সম্প্রদায় ভূক্ত। পরিবারটির কর্তা রেশন ডিলার, খাদান মালিক, দু'টি লরীর মালিক এবং তেজারতি কারবারি। শুনানি কালীন দেখা গেল দলীল গুলির জমির পরিমাণ সামান্যই বটে কিন্তু ঐগুলিই ছিল বিক্রেতা দের একমাত্র চাষজমি। দুই পক্ষকে ডেকে শুনানি করে সবকটি দরখাস্তের ফয়সালা সহজেই করে দেওয়া গেল যেহেতু দরখাস্তকারিদের কারোর জমি দুই হেক্টরের কাছে পিঠেও ছিল না এবং ক্রেতাদের প্রত্যেকেরই এক হেক্টরের বেশী জমি ছিল। এছাড়া ক্রেতারা একমাত্র কৃষি কাজেরই উপর নির্ভর করে সংসার নির্বাহ করতো না। হস্তান্তর গুলি সবই হয়েছিল ১৯৬৮ সাল নাগাদ। বহু বছরের ফসল উপভোগ করার কারণে কম্পেনসেশন বাবদ ক্রেতাদের পাওনা অর্থের পরিমাণ নির্ধারিত হয় অতি সামান্য। সেই পরিমাণ ও দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না ঐসময় প্রচলিত Rural Indebtedness Relief Act এর বিধান অনুযায়ী। জমি গুলি সবই ফেরত হয় বিক্রেতাদের কাছে।
এই শুনানি চলাকালীন এই আঠারোটি পরিবারের আর্থিক দুরবস্থার করুণ চিত্র আমার কাছে বিবৃত হয়েছিল। লোধা সম্প্রদায়ের শ্রীহীন জীবনের চিত্র আরও পরিষ্কার ভাবে জানবার সুযোগ হয়েছিল। এদের অনেকের কাছেই বাসভাড়ার সামান্য অর্থটুকু পর্যন্ত থাকতো না। তাদের শুনানির পরে বাড়ি পৌঁছে দিতে কয়েকবার তৎকালীন বিডিও সাহেব তাঁর গাড়ীটি দিয়ে তাঁর ব্যতিক্রমী চরিত্রের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। শুনানি কালীন এই সব সরল সাদাসিধে মানুষগুলি ও মুরুব্বীটির মুখ থেকে লোধা সম্প্রদায়ের উৎপত্তি নিয়ে অনেক লোককথা জেনেছিলাম। তার কয়েকটি এইরকম:- অতীতে লোধা দের পূর্বপুরুষের বসবাস ছিল মধ্যভারত সংলগ্ন অঞ্চলে। সমৃদ্ধ রাজত্ব ছিল তাদের। তারা ছিলো রাবন রাজার করদ রাজ্য। শূর্পনখা ছিলেন ঐ রাজ্যের রাজকন্যা। এক রাজকুমারীর পক্ষে রাজপুত্র লক্ষ্মণের পাণিপ্রার্থনা ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। শূর্পনখার অপমান রাবন রাজা, যিনি ছিলেন পরম প্রজাহিতৈষী, তাঁকে প্রচন্ড ক্রুদ্ধ করে আর সেই কারণেই যুদ্ধ বাধে। তবে সবথেকে পীড়াদায়ক ঘটনা ঘটে রামচন্দ্র যখন যুদ্ধজয় ও বনবাস পর্বের শেষে অযোধ্যায় ফিরছেন, সেই সময় তাঁর বিজয়ী সৈন্য বাহিনী লোধা রাজত্বে অবর্ণনীয় অত্যাচার নামিয়ে আনে। মেয়েরা ও শিশুরা বিশেষ করে আক্রমণের শিকার হয়। ভয়ে এই রাজ্যের বাসিন্দারা সকলেই দেশান্তরে বহু দূরবর্তী স্থানে অরণ্যচারীর জীবন যাপন করতে থাকে। রাতারাতি এই সম্প্রদায় সমৃদ্ধ কৃষিজীবীর জীবনের পরিবর্তে অরণ্যে বিচরণকারী বনজ দ্রব্য সংগ্রাহকের জীবন মেনে নিতে বাধ্য হয়। তাদের কথা মতো এই অত্যাচারের প্রতিশোধ স্পৃহা নাকি তাদের রক্তে রয়ে গিয়েছে; সে কারণেই লোধা তরুণেরা ডাকাতি, ছিনতাই, মারধর ইত্যাদি কুকর্মে জড়িয়ে পড়ে। তাদের এই ঝোঁক নষ্ট করে সুপথে পরিচালিত করতে নাকি মাঝে মাঝে সামাজিক বৈঠক করা হয়। যাইহোক, এতগুলি মানুষ, সমাজের প্রান্তভাগে যাদের বাস, আইনের সফল প্রয়োগে তাদের কিছু সুরাহা করতে পেরে খুব তৃপ্তি পেয়েছিলাম। এই সহজ সাদাসিধে সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে শুধু আমার কাঠবেটা ক্ষিতীশ নয়, এই আঠারোটি আলাদা আলাদা লোক এর কারণেও এক অদ্ভুত মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে গিয়েছিলাম। এই বন্ধন পারস্পরিক বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। সে বিবরণ পরে কোনো সময়ে প্রকাশ করা যাবে।
*কাঠবেটা একটি অসংস্কৃত শব্দ। সমাজের প্রান্তবর্তী অঞ্চলে যাদের বসবাস অনেক সহজ তাদের জীবনযাপন। কোনও স্ত্রীলোক তার স্বামীর সংসার ত্যাগ করে অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে সংসার পাতলে স্ত্রীলোকটির আগের পক্ষের সন্তানের কাঠবাপ হবে এই নতুন পুরুষটি। সন্তানের পরিচয় কাঠবেটা বা বেটি!!
** বিশেষ কারণবশত মুরুব্বীটির নাম উল্লেখ থেকে নিবৃত্ত রইলাম, পরের অংশে তা প্রকাশ পাবে।
২১/৭/২০২৪
☀️ রাধা যেমন সাদা লো সই,
কৃষ্ণ যেমন কালো।
দুই জনের মিলনে সই,
জগৎ হইলো আলো।। ☀️
আশীষ সরকার
আগের পর্বের বছর তিনেক পরে আমি তৎকালীন ঝাড়গ্রাম সাব ডিভিশনের সাঁকরাইল থানায় জেলআরও হিসেবে কর্মরত। থানা/ব্লকটি একেবারেই পিছিয়ে পড়া। কোনও একটি জনবসতি সবকটি দপ্তরকে জায়গা দিতে পারে নি। বিডিও অফিস রোহিনীতে, সেটেলমেন্ট সেন্ট্রালাইজড ক্যাম্প কুলটিকরিতে, থানা সাঁকরাইলে আর জেএলআরও দপ্তর কেশিয়াপাতায়। শেষের তিনটি দপ্তর একই রাস্তায়, বিভিন্ন দূরত্বে। এই ব্লকের মাঝামাঝি বয়ে গিয়েছে ডুলুং, উত্তর থেকে দক্ষিণে; একসময় নিজেকে সুবর্ণরেখায় সঁপে দিয়েছে সে। ডুলুং আর সুবর্ণরেখার মধ্যবর্তী এলাকায় যে সব জমি এই ব্লকের পশ্চিম দিকে, সে জমি যেন সোনার ও বাড়া, অতীব উর্বর। কিন্তু ডুলুং এর পূর্ব দিকের জমি বেশিটাই রুক্ষ, অনুর্বর।
১৯৮৫ সাল নাগাদ তৎকালীন শাসক দলের কৃষক সমিতির সংগঠন ক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছে। স্হিতাবস্হার বিরোধী তারা। কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার যে সব কায়েমী চরিত্র এই সব প্রত্যন্ত অঞ্চলে এতাবৎকাল গভীর ভাবে স্হিত ছিল, সেগুলি জোরালো চ্যালেঞ্জ এর মুখে। ব্যাপক গোলমাল চাষাবাদ নিয়ে। জুলাই- আগস্ট মাসে থানার বড়বাবু আর আমার কাজ এইসব গোলমাল মিটিয়ে চাষের কাজ উৎরে দেওয়া। রাস্তার অবস্থা বিভীষিকাময়, জীপ গাড়িও চলে না। মোটরবাইক, মোপেড আর সাইকেল ভরসা। গ্রামে গ্রামে ঘুরে, মেঠো সভা করে, আইন, রুল আর সরকারি আদেশনামা মেনে কৃষি কাজে কার আইনসম্মত অধিকার তা ঘোষণা করে উভয়পক্ষকে শান্তি বজায় রাখার কড়া নির্দেশ দিয়ে সম্মতি পত্রে স্বাক্ষর ইত্যাদি সেরে কেশিয়াপাতা ফিরতে রাত আটটা নটা বেজে যেত (তৃপ্তি একটাই ছিলো, যে সম্মিলিত চেষ্টায় কোনও একটাও বড় অশান্তি হয়নি)।
যে রাস্তার ওপর আমার অফিস, সেখান থেকে এক কিলোমিটার দূরে থানা। এই রাস্তা দক্ষিণে চলে গিয়েছে হাতিগেড়িয়া, যেখান থেকে পূর্বোক্ত ডিমৌলীচক সালুয়া গোপালী আই আই টি হয়ে আমার বাসাবাড়ি ৩৭/৩৮ কিলোমিটার। আর উত্তরে গেলে বাকরা হয়ে গুপ্তমনিতে এন এইচ সিক্স। সেটি ধরে বাসাবাড়ি প্রায় একই দূরত্বে। তবে এই রাস্তায় রাত্রে দ্রুতগতির যানের আধিক্য; সেই সময়ে রাস্তাও ছিল সংকীর্ণ সুতরাং দুর্ঘটনা বহুল।
কিছু পূর্বে আমার পিতৃবিয়োগ হয়েছে। তাঁর সন্তানদের মধ্যে কনিষ্ঠটি আমি,অর্থনৈতিক অবস্থানে দুর্বলতর, একারণে মা আমার সঙ্গেই থাকতে ইচ্ছুক। অনেক বছরের সঙ্গীকে হারিয়ে মা বেশ কিছুটা ডিপ্রেশড, সুস্থ থাকার সময়ও ফুরিয়ে আসছে। কর্মস্থলে চলে আসলেই ভালো হয়, কিন্তু শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শ মেনে খড়্গপুরের বাসাবাড়ি রেখে দিয়েছিলাম। একটি কমবয়সী মেয়ে, কাজল, সারাদিন বাসায় মা'র কাছে থাকে; ঘরের কাজ রান্নার কাজে সাহায্য সেই করে। আবার পুরাতন বাজারে সিনেমা হল, শীতলা, সেখানে নতুন নতুন বাংলা মুভি আসে, সেখানেও সে মাকে জোরাজুরি করে নিয়ে যায়। সারাটা দিন এইভাবেই বাসায় মা'র দিন কাটে। কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকেই ছেলের ফেরার অপেক্ষায় ব্যস্ত হতে থাকেন। এই সব কারণে বাসায় ফেরার তাগিদ আমার বাড়তেই থাকে।
রাত বাড়লেই কেশিয়াপাতা থেকে ফেরার রাস্তা বিপদসংকুল। অন্য কিছু নয়, দু'পেয়ে জীবের থেকেই ভয়। যেদিন আমাদের যৌথ অভিযানে দেরি হয়ে যায়, থানার বড়বাবুর সৌজন্যে তাঁর রাত পাহারার জীপ আমাকে কিছুদূর অবধি এগিয়ে দেয়। বলতে ভুলেছি, আমি এখন একটি রাজদূত মোটর বাইকের মালিক। সেটি ব্যতীত গত্যন্তর নেই কারণ, কেশিয়াপাতা থেকে শেষ বাস তিনটে পনেরো মিনিটে!
এই রকমই এক রাতে, আমি সামনে বাইকে আরূঢ়, পিছনে থানার জীপে কয়েক জন হোমগার্ড, কনেষ্টবল আর ছোট বাবু। কেশিয়াড়ীর কুসুমপুরের কাছাকাছি জীপের চালক তিনবার ডিমার দিলেন। বুঝে গেলাম ওঁরা ফিরে যাবেন। আমি হর্ণ বাজিয়ে সম্মতি দিলাম। এবার একা।
এখন কেশিয়াড়ী থানার এলাকায়। বর্ষাকাল হলেও বৃষ্টি নেই। ফাঁকা রাস্তায় পঞ্চাশ পঞ্চান্ন বেগে চলেছি। এই পথে হাতিগেড়িয়া পর্যন্ত কিছু শালজঙ্গল। তারপর কেশিয়াড়ী খড়্গপুর সড়কে পুবমুখে ঘুরলাম। অল্প কিছু জঙ্গল, এরপরে খাজরা। কাছেই কালুয়াঘাই ব্রীজ, ধবনী। এ আমার চেনা রাস্তা। ডিমৌলীচক কিছুটা আগে। কোনও গাড়ি নেই সামনে পিছনে। সহজ ছন্দে চলেছে বাইক। হঠাৎ মনে হলো সামনে একটা নতুন বাম্প, বোল্ডার দিয়ে উঁচু করে তৈরী, রাস্তার বাঁ পাশে যেন অনেক টা নীচের থেকে ডান পাশেও অনেকটা পর্যন্ত তার বিস্তার। এটা তো আগে দেখিনি, তাহলে কি ঘোর বর্ষার মধ্যে রাস্তায় কাজ শুরু হ'ল! রাজদূত এর আলো কিছুটা দুর্বল। এক্সিলারেটর বাড়িয়ে ভালো করে দেখার চেষ্টা কাজে এল না। বাঁ দিকে একটু নিচের দিকে হ্যান্ডেল ঘুরালাম। এই অবস্থায় রাস্তার দুই পাশের অন্ধকার থেকে কয়েকজন উঠে এলো। তাদের হাতে লাঠি, এক দু'জনের লাঠির ডগা চকচক করছে,সড়কি নাকি! সকলের মুখ মাথা সাদা কাপড় জড়ানো। আর সত্যিকারের পিলে চমকে দেওয়া চিৎকার। এই অবস্থায় বাইকের স্টার্ট গেল বন্ধ হয়ে। কোনো রকমে টাল খেয়ে আমি একটা পা মাটিতে রাখতে পেরেছি, সেটাও কাদার মধ্যে। লোক গুলো চিৎকার করছে আর আমার বাইকের সামনের টায়ারে, সীটের পিছনে দমাদ্দম লাঠির বাড়ি মারছে, এক দু'টো যেন আমার পাছায় ও পড়লো। আমি হতবুদ্ধি, ঘামতে লেগেছি। হঠাৎ অন্ধকার ফুঁড়ে একজন উঠে এলো বিদ্যুৎ গতিতে। মুখে আওয়াজ আ....হা হা, আ.....হা হা, আরও কিছু দুর্বোধ্য শব্দ, যার মধ্যে নাহ্ টা আমি বুঝতে পারছি। লোকটার কথায় কতৃত্ব ছিল। ঠ্যাঙাড়ে গুলো থেমে গেল। সে আরও কিছু বলায় তারা একটু দূরে হঠে গেল। লোকটা কিছুটা কৃত্রিম স্বরে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, তুই সেই জেলার টা না? আমি হ্যাঁ বলায় যেন রেগে গিয়ে বললো এতো রাতে আমি কোথা থেকে আসছি। আমি সংক্ষেপে আমার বর্তমান পোস্টিং ইত্যাদির বিবরণ দিলাম। লোকটা একই রকম দুর্বোধ্য ভাষায় ঠ্যাঙাড়ে গুলোকে কিছু বলতে তারা রাস্তার ধার থেকে কয়েকটা বোল্ডার সরিয়ে নিয়ে যেন আমার এগিয়ে যাওয়ার পথ করে দিল। ওদের মধ্যে একই ভাবে আরও কিছু কথা চলেছে, ঠ্যাঙাড়ে দের একজন এগিয়ে এসে তিরিক্ষি ভাবে বললো, যা চলে যা! আমি যদিও ততক্ষণে মাটিতে কাদায় দুই পায়ে দাঁড়িয়ে পড়েছি আর বাইকের সাইড স্ট্যান্ড নামাতে পেরেছি, ঘটনার অভিঘাত আমাকে স্হানু করে দিয়েছে। হঠাৎ এক দু'জন আবার লাঠি উঁচিয়ে চলে এলো। তাতেই চটকা ভেঙে বাইক পিছনে টানার চেষ্টা করলাম। পা হড়কে যাচ্ছে, বাইক আর নড়ে না। আমার অবস্থা দেখে লোকগুলো কয়েকজন ক্লাচ টেনে সেটাকে কাদা থেকে তুললো। আমার প্রতি হুকুম হলো স্টার্ট করে চলে যাওয়ার। কিন্তু স্টার্ট হলে তো! টু-স্ট্রোক ইঞ্জিন ওভারফ্লো করে থমকে গেছে, তাকে চালু করা কি অত সহজ! লোকগুলো নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছে। আমার মধ্যে কেউ যেন বলছে আমাকে মারবে না এরা। আমি গলায় যতটা সম্ভব জোর এনে ওদের বললাম বাইকটা ঠেলে সামনের ঢাল অবধি নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিলে স্টার্ট করে চলে যাবো। সেই রকমই হলো, ঢাল বেয়ে নামতে নামতে ফার্স্ট গিয়ার দিতে কয়েক বার আপত্তির পর বাইক বাবাজী চালু হলেন। কিছু পথ পেরিয়ে গোপালী তে একটা মিষ্টির দোকান খোলা রয়েছে দেখে দু তিন গ্লাস জল চেয়ে খেলাম। ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা কাটাতে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। একটা সিগারেট কিনতে গিয়ে সেখানে কৈফিয়ত দিতে হলো প্যান্ট জামায় কাদা কেন। পড়ে গিয়েছিলাম বলায় দুয়েক জন ঠাট্টা করলো যে আমার তাড়নায় ডাঙ্গায় ছুটতে গিয়ে কতজনের এরকমই পতন হয়েছিল। অনেকটাই রাত হয়ে গেল বাসায় ফিরতে ফিরতে। মাতৃদেবী প্রায় ক্রন্দনোন্মুখ। তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে প্যান্টজামা ছেড়ে খাওয়া দাওয়া সেরে উঠতে মধ্যরাত্রি পার।
পশ্চাদ্দেশে এক দুই ঘা লেগেছে, কিন্তু বাইকটা রাতে যতটা দেখা গেছে কোন ক্ষতি হয় নি। শুয়ে শুয়ে ভাবছি আগাগোড়া। হঠাৎ মনে এল ঐ যে লোকটা চিৎকার করে দৌড়ে আসছিল ও যেন বলছিল বিরমা নাহ্ ধরনের কিছু। ক্ষিতীশ বলেছিল না, ওরা নিজেদের মধ্যে এক নিজস্ব ভাষায় কথা বলে! সেটা নাকি সহজ, শব্দগুলো পিছন থেকে উচ্চারিত হয়! বিরমা মানে তাহলে মারবি, আর নাহ্ তো আমি শুনেই ছিলাম!
তাহলে লোকগুলো ঠিক কারা! দৌড়ে আসা যে লোকটি আমাকে বাঁচালো, সে কি ঐ মুরুব্বী? কিন্তু, সে তো ছিল শ্লথ, নিম্ন স্বরে কথা বলতো। তার চলনে এই গতি, বলনে এই তেজ তো আমি কখনোই দেখিনি। না, সবারই মুখ ঢাকা ছিল। কারুকেই আমি দেখি নাই! কারুকেই আমি চিনিতে পারি নাই!
পরের দিন অনেক বেলায় ঘুম ভাঙ্গলো। পিছনের ব্যথাটা অনেক কম। জামা প্যান্ট কেচে কাজল মেলে দিয়েছে। মা সকালের চা খেয়ে স্নান টান সেরে নিয়ে ঠাকুর পূজো ও করে ফেলেছে। সেদিন সকালে বৃষ্টি ও হচ্ছিল থেমে থেমে। একটা নতুন দিন। গতকালকের শরীরের ক্লেশ ও মনের ক্লেদ ধুয়ে যেতে থাকলো। আমি ঘোষণা করে দিলাম আজ রেইনী ডে, অফিস ছুটি !!
সংযোজন: কয়েক দিন পরে, রবিবার হবে, ক্ষিতীশ তার বৌকে নিয়ে হাজির। সঙ্গে একটা ব্যাগ। তার থেকে বেরোলো একটা বিরাট মোরগ। এতো বড় মোরগ আমি তার আগে বা পরে দেখিনি। ক্ষিতীশ বললো ওটা বনমোরগ, সে অনেক দূরের জঙ্গল থেকে ধরে এনেছে। মা এবং কাজলের আপত্তিতে সেটাকে বধ করা হলোনা। বস্তুত ঐ রকম একটা রাজকীয় plumage সম্পন্ন পাখি কাটাকুটি করে খাওয়া হ'বে, এটা ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল। সে বেচারাকে ক্ষিতীশের সাথে ফেরত পাঠানো হ'ল, যদিও তার ভবিষ্যৎ কি হয়েছিল তা জানা নেই। ক্ষিতীশকে সঙ্গে নিয়ে বাজার থেকে মুরগির মাংস নিয়ে এলাম। তা ই রগরগে করে দুপুরে খাওয়া হলো। এর আগে ক্ষিতীশ কয়েকবার আমার বাড়ীতে এলেও তার বৌ এই প্রথম বার এল। তাকে এই প্রথম বার আমি ঘরের বাইরে বের হতে দেখলাম। কয়েক বার ওদের বাড়ি গিয়েছি, সব সময়েই তাকে মাথায় ঘোমটা দিতে দেখেছি। তার তৈরি করা ছাগল এর দুধের চা ও খেয়েছি। আমার বাসায় তার সঙ্গে কাজলের খুব ভাব হয়ে গেল একবেলার মধ্যেই। ছাদের ওপরে নাকি তাদের পরস্পরের মাথার উকুন বেছে দিতে দেখা গিয়েছিল। ক্ষিতীশের কাছে জেনেই হয়তো, কাজলের জন্য সে চুল বাঁধার ফিতে ইত্যাদি নিয়ে এসেছিল। ফিরে যাওয়ার সময়ে ক্ষিতীশ ও তার বৌ মাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে, কাজলকে আদর করে মায়ের খেয়াল রাখতে বলে গেল। ক্ষিতীশ বা আমি কেউই ঐ রাত্রের বিষয়ে কিছুই আলোচনা করিনি।
এর কয়েক মাস পরে আমি কৌমার্য হারালাম। খড়্গপুরের শ্রীমতী কাবেরীকে বিবাহ সূত্রে। সংসার আর অফিসের কাজে দেওয়ার পর হাতে সময় বিশেষ বাঁচেনি, অন্তত পরের বেশ কয়েকটা বছর।
আশীষ সরকার,
মুঠোফোন: ৯৯৩২৯০৯০৬১

নিবাসঃ খড়্গপুর, পঃ মেদিনীপুর
চাকরিতে যোগদানঃ ১৫/০৯/১৯৭৯ জে এল আর ও বালিচক, মেদিনীপুর
অবসরঃ ৩১/১০/২০১৩ এস ডি এল এল আর ও, মেদিনীপুর সদর