top of page

প্রবীর চট্টোপাধ্যায়

prabir chatterjee.jpg

বর্তমান বাসস্থানঃ কিন্নর অ্যাপার্টমেন্ট,১০২/এ, কে কে মজুমদার রোড, সন্তোষপুর (যাদবপুর)

কলকাতা- ৭০০০৭৫

চাকরিতে যোগদানঃ ২/৫/১৯৯০ ওরগ্রাম, বর্ধ্মান

অবসরঃ ৩১/০১/২০২১ এস ডি এল এল আর ও, উলুবেড়িয়া, হাওড়া

মোবাইল নং  ৭০০৩৬৯১৬৬০

*ফেলে আসা দিনগুলি.......* প্রথম পর্ব

🔴🔵🔴🔵🔴🔵🔴🔵

 

---- প্রবীর চট্টোপাধ্যায় 

   

 

      উনিশশো নব্বইয়ের পয়লা মে। বর্ধমান স্টেশনে নেমে ছাগল মুরগি মানুষে কানায় কানায় ভর্তি আর ঠাঁই না হওয়া ' সোনার তরী' জনতা বাসে কোনও মতে একটু জায়গা জুটে গেল।ঘণ্টা দুই বাদে ভরদুপুরে রাস্তার ধারে ঝাঁকড়া মাথা মস্ত এক শিরীশ গাছের নীচে বাস আমাদের উগরে দিয়ে ডিজেলের একরাশ কালো ধোঁয়ার শুভেচ্ছা জানিয়ে ঘড়ঘড় বুকের আওয়াজ নিয়ে চলে গেল। আমাদের মানে আমার সমবয়সী মাসতুতো ভাই পীযূষ এই অভিযানে স্বেচ্ছায় রাজি হয়েছে।দুধারে শুনসান ফাঁকা মাঠ। রাস্তায় জন-মানুষের চিহ্ন নেই। নেই কোন ট্রলি বা ভ্যান।  রিক্সা পাওয়ার কথা ভাবাটাই তখন বিলাসিতা।কাঁঠালপাকানো দুঃসহ গরম আর কাঠফাটা রোদ মাথায় করে হোল্ডঅল আর ব্যাগ কাঁধে চাপিয়ে মাইলখানেক পথ ঠেঙিয়ে জীবনের প্রথম সরকারি চাকরিতে যোগ দিতে বর্ধমানের ওরগ্রামে এক অব্যবহৃত স্কুল বাড়িতে উঠলাম। শালবনিতে *অধুনা ঝাঁ চকচকে এআরটিআই-এর* জন্ম দিতে ডিপার্টমেন্ট তখন প্রসব যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।

কিন্তু চারপাশে তাকিয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল। জায়গাটা রিজার্ভ ফরেস্টের মতো। শাল সেগুন ,শিশু , শিরীষ, ইউক্যালিপ্টাস -- অনেক অনেক গাছের মজলিশে ভরা। মাঝে মন কেমনকরা লাল মোরামবিছানো রাস্তা। নিউলি রিক্রুটেড , গালভরা নাম ডব্লিউবিএসএলআরএস- গ্রেড ওয়ান এর প্রথম খেপের চুরাশি জনের প্রায় আধাআধি ঐদিন  ঠেলে উঠলাম।বাকিরা এল পরদিন। ঘরপিছু তিন চৌকিতে তিন পিস্ ট্রেনি।

এই হল থাকার বন্দোবস্ত। সরকারি মজুরিতে রান্নার ঠাকুর আর জনা পাঁচ-সাত অন্যান্য কাজের লোক।খাওয়ার খরচ আমাদের। মেস চালানোর দায়িত্ব শৈবাল চক্রবর্তী  ( পরে আবগারি ডিপার্টমেন্টে চলে যায় ) যেচে নিজের ঘাড়েই নিল। 

    তবে কদিন যেতেই খেয়াল হল মেনু কপি-পেস্ট হচ্ছে -- ডাল ঢ্যাঁড়শের ঘ্যাট আর ডিমের ঝোল। ডাল ভাতে মেখে খাওয়া ছাড়াও তা দিয়ে হাত ধোয়া এবং জামাকাপড় কাচাও চলতে পারে। আর কড়াইতে ডিমের ঝোলে ডিম তুলে আনতে গামছা পরে নামলে সুবিধা হবে। এভাবে দিনসাতেক চলার  পরেই সকলে  " হোক কলরব" এ সামিল হল এবং অনিবার্য ভাবে এক সন্ধ্যায় সিধুর  ( সিদ্ধার্থ বোস, বর্তমানে হাওড়ায় এল- এ -তে কর্মরত ) নেতৃত্বে যে মিটিং আহ্বান করা হল সেখানে সিধু সবার সামনে বাজখাঁই গলায় হাঁক দিল, " বন্ধুগণ, আমরা ট্রেনিং পীড়িত ছানাগণ দুবেলা যে মিল সেবন করছি তা খরচে গায়ে গতরে হলেও গলা দিয়ে চেষ্টা করেও নামাতে পারছি না। সরকারি ত্রাণের লপসিও এর থেকে সুস্বাদু। আমরা কি মেসটা অন্যভাবে চালাব ? " সকলে হৈহৈ করে সমস্বরে সমর্থন করে সিধুকেই বলল হাল ধরতে। এবার সিধু উদাত্ত গলা মেলে ধরল," না আমি না,তবে যার নাম পেশ করছি তার বিখ্যাত হিন্দু হোস্টেলের মেস চালানোর অভিজ্ঞতা আছে।" সবাই উসখুস করতে  লাগল । 

একটু থেমে বলল," ঐ যে আমাদের চাটুজ্জে মানে প্রবীর চ্যাটার্জি ।" বিনা বিতর্কে প্রস্তাব পাশ এবং সেইসাথে সিধুর দেওয়া " ম্যান-জারবাবু " খেতাবের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত লাভ। আমি উঠে দাঁড়িয়ে  সকলকে উদ্দেশ্য করে বললাম, " আপনারা যোগ্য মনে করে যে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন তা আমি আমার জ্ঞান ও বিশ্বাসকে পুঁজি করে পালন করার যথাসাধ্য চেষ্টা করব। কিন্তু দুটৌ শর্ত , এক- আমাকে সাহায্য করতে কয়েক জনের টিম গঠন করতে হবে , আর দুই- সকলকেই সকালে ক্রমান্বয়ে বাজারে যেতে হবে ।" বলা বাহুল্য, ওরা কথা রেখেছিল। সিধু,  মিলন কুণ্ডু, মানস সেনগুপ্ত, অলক চ্যাটার্জি ,অনুপম দাস মজুমদার, নির্মল মুখার্জি, দীপক মুখার্জি , ভবেন মণ্ডল, সর্বজনপ্রিয় শিবুদা ( শিবশংকর দাস আজ অনেকদূরে দিকশুন্যপুরে  অন্যলোকে ) --আরও অনেকে অকুণ্ঠ সাহায্য করেছে। অনুপম দাস মজুমদারের  নামের বহরের সাথে পাল্লা দিয়ে তার দেহ বল্লরীর বিস্তার। ঝাড়গ্রামে প্রথম দিন বিএলআরও অফিসে জয়েন করেই বেচারা স্টীলের চেয়ারটি তার ' স্বল্প ' দেহের ভার সইতে  না পেরে দেহত্যাগ করে।পরে তার জন্যে পোক্ত কাঠের চেয়ার বরাদ্দ হয়।

কিন্তু এমন সহৃদয় রসিক পরোপকারী সহকর্মী কমই দেখেছি। মুখে মুখে যেকোনো বিষয়ে অনবদ্য ছড়া বানাত এবং তাতে থাকত শিব্রামীয় pun এর মুন্সিয়ানার প্রয়োগ। 

একটু নমুনা দেওয়া যাক -- ম্যানেজারের মাথা ডাল ( dull ), / আজ মেনু ভাত - ডাল, / সাথে ঘ্যাট খুব ঝাল।

       আমি দুবেলা নিজহাতে মিল রেজিস্ট্রার 'মেনটেন' করতাম। তাছাড়া তখনও অবধি ভৃমি সংস্কার কী বুঝে উঠতে না পারলেও, অনেকের প্রবল আপত্তি সত্বেও একটি "ঐতিহাসিক মেস সংস্কার" করেছিলাম -- ফিক্সড কস্ট এবং ভ্যারিএবেল কস্ট। এতে ট্রেনিদের খরচে মিল সংখ্যা কম ও বেশির মধ্যে কিছুটা সমতা এল। দূরবর্তী জেলা থেকে আগতদের মিল সংখ্যা বেশি হত বলে তারা উপকৃত হল।

           ডালের 'স্পেসিফিক গ্রাভিটি ' আগেই বলেছি। তো এহেন ঠাকুরের একটি দুর্দান্ত রেসিপি উল্লেখ না করলে আমার সাধ বা সেই ফেলে আসা ' স্বাদ ' অপূর্ণ রয়ে যাবে। 

            দিনটা  কোনও এক শনিবার। খুব সম্ভবত জামাই ষষ্ঠী।কামাই শুরু হলেও জামাই হওয়া তখনও ঢের বাকি। সেই সময়ে সেকেন্ড স্যাটারডে আর ফোর্থ  স্যাটারডে ছুটির চল ছিল। অধিকাংশই থেকে যেত।কাছাকাছি যাদের তারা বাড়ি থেকে ঘুরে আসত। আমার যাওয়া হত না। এতগুলো ছানার খানার গুরুদায়িত্ব যে!

তো বেশ কজনার বাসনা হল রাতে লুচি -পায়েস খাবে। সিধু শুনে হৈ হৈ করে উঠল , " ওহে ম্যান-জার ! দুবেলা তো ভালই জুটছে।আর গলাও কাটা যাচ্ছে না,গলা দিয়ে নামছেও ভাল। গুরু এই মেনু নামিয়ে দাও দিকি!" সুতরাং তথাস্তু !

বলে রাখি হিন্দু হোস্টেলের বাসি জ্ঞানে প্রতি সপ্তাহের অ্যাডভান্স মেনু বানাতাম যেন অ্যাকশন রিপ্লে না হয়। তখন রাত প্রায় দশটা। সবাই হাঁউ-মাঁউ-খাঁউ করছে। " কী হে ঠাকুর! কদ্দূর? এরপর তো ওরা আমায় খেয়ে ফেলবে!", ঠাকুরকে তাগাদা লাগালাম। মাখা ময়দার 'লেচি ' কাটতে কাটতে অম্লান বদনে বলল," ভাত অনেক আগেই করে ফেলেচি।দুধ ফুটে উঠলেই ওতে ঢেলে দেব।ব্যস্ ! আপনারা বসার তোড়জোড় করে ফেলুন।" শিবুদা যেন প্রিয়জনবিয়োগ ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল। মনে আছে সেই রাতে শিবুদা নাইট গার্ডের সাইকেল নিয়ে দূরের গ্রাম থেকে কামিনী আতপ জোগাড় করে নিজের হাতে পায়েস বানায়। সকলকে খাইয়ে  ঘড়িতে দেখি বারোটা অনেক আগেই বেজে গেছে এবং সেইসঙ্গে আমার ক্ষিদেরও।

    পাঁচজন করে এক একটি টিম করে দেওয়া হয়েছিল হাতে কলমে জমির জরিপ শিখিয়ে দিতে। প্রতি টিমে একজন আমিনবাবু ও চেন পিওন থাকতেন। সমস্ত টিমের  ওভার অল সুপারভিশনের দায়িত্ব ছিল টি এ সাহেবের। মনে আছে আমরা কুমারদার দুর্লভ সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। রোজ সকালেই মাঠে যেতে হত। ঠাকুরদের মেনু বুঝিয়ে দিয়ে আমি  দেরিতে যেতাম। আসতামও একটু আগে রান্নার স্ট্যাটাস জানার জন্য।আমার টিমের সিধু আর মানস ম্যানেজ করে দিত। কিন্তু  গিয়ে জরিপ শেখায় খুব বেশি মন দিতে পারতাম না। ভাবতাম " ঐ সব ' গুণিয়া '  ( ম্যাপে দূরত্ব মাপের জন্য ছোট্ট স্কেল ) কী হবে শুনিয়া, ওরে চেয়ে দেখ - এ যে অন্য দুনিয়া! "

    ঐ দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। পায়ের নীচে ভিজে ঘাসের উঠে আসা অচিন গন্ধ । ভোরের মৃদু ঠান্ডা ঝিরঝিরে বাতাস।একটু দূরে সারি সারি তালগাছের পাতায় হাওয়ায় ওঠা মন কেমন করা ফিসফিসানি মৃদু ধ্বনি। কালো কষ্টিপাথরে খোদাইএর মতো মেদহীন সুঠামদেহী আদিবাসী নারীপুরুষের সহজ সরল অনারম্বর জীবন। এসব আমায় উদাস করে দিত। ইঁট- কাঠ-লোহা- পাথরের কলকাতার কীট আমি!  গোগ্রাসে তাই গিলতাম। মাঝে মাঝে আমিনবাবুর ডাকে সম্বিত ফিরত। বারেবারে একটা কথা মনে হত যে এত কেজো লোকের মাঝে একআধ জন যদি একটু উদাসী আর অকেজো হয়ইবা,  তাতে বিপুলা এ পৃথিবীর কী এমন হেলদোল ঘটবে!

ওরগ্রামে ত্রিশে জুন মাসদুই সার্ভে এবং অন্যান্য ট্রেনিং শেষ করার পরে পাঠানো হল ঝাড়গ্রাম। সেখানে দশমাস দশদিনের উটোর(U.T. R.O.  ) ইন সার্ভিস ট্রেনিং শেষ করে অবিভক্ত পশ্চিম দিনাজপুরের বুনিয়াদপুর ব্লকে আর ও হিসেবে ভূমিষ্ঠ হলাম। দেখলাম বিএলআরও -এর চেয়ারে শোভা বর্ধন করছেন  ধীরেন শীল। প্রাথমিক পরিচয় পর্ব শেষ করে তিনি এল-ডি-সি শিশিরবাবুকে আমার পেশকার হতে লোকাল অর্ডারবুকে লিখে দিলেন।অ্যাটেনডান্স রেজিস্ট্রার এগিয়ে দিয়ে, "আমায় দাদা বলেই ডাকবেন ", সাদা মনেই বললেন ।

       সুধাংশু সিংহরায়।প্রাক্তন জেএলআরও । কিন্তু নতুন ইন্টিগ্রেটেড সেটআপে আর ও -র পদমর্যাদায় বহাল হতে হয়েছে । তাঁর কথা কোনও দিন ভুলতে পারব না।প্রথম দিনেই আমায় সাদরে গ্রহণ করলেন। উনি সঙ্গে করে বিএলআরও সাহেবের কাছে নিয়ে গিয়ে আর এক প্রস্ত আলাপ করিয়ে দিলেন। পরে তাঁর ঘরে নিয়ে বসিয়ে চা এবং একটু বাদে পরোটা-আলুরদম খাওয়ালেন। স্নেহের সুরে বললেন, " আজ অফিসে প্রথম দিন । ক্লান্ত। আর লেখালেখির ঝামেলায় যেতে হবে না।আমিই জয়েনিং রিপোর্ট লিখে দিলাম।" ,বলেই এগিয়ে দিলেন," নিন , একটা সই করে দিন দিকি! "

শেষে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে কে কী ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করে তা বুঝিয়ে দিলেন। পয়লা দিনেই এত্তসব.... মাথায় ট্যানজেন্ট হয়ে বেরিয়ে গেল। আমার অবস্থা অনুমান করে বিচক্ষণ সুধাংশুদা মুচকি হেসে, "মুষড়ে পড়ার কিচ্ছু নেই। আস্তে আস্তে সব বুঝে যাবেন।" একসময় রেকর্ড রুম দেখানো হল। তখনে বেলা গড়িয়ে দিনের আলো অনেক কমে এসেছে । শেল্ফে রাখা সাদা কাপড়ে মোড়ানো সারি সারি মৌজা বাণ্ডিলগুলোকে মর্গে রাখা শবদেহ মনে হচ্ছিল। 

সত্যিই তো,শবদেহই বটে! ঐ কাপড়ের পুটুলিগুলোর মধ্যেই যে শায়িত  আছে কত লোভী ও নিষ্ঠুর  লোকের হিংসা,  শঠতা আর লোভের যখের ধন আবার কারো কারোর রক্ত, চোখের জল আর ঘামের কষ্টার্জিত সঞ্চয়।

 সামনে দাঁড়িয়ে আবলুস কাঠে বানানো মূর্তির মতো রেকর্ড রুমের পিওন সুফল মার্ডি। আমার কেমন যেন গা ছমছম করতে লাগল।তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম। এই সুফল মার্ডিই আমার কর্ম জীবনের সর্বপ্রথম "মাস্টারমশাই"-- রেকর্ড বোঝানোর ,বিশেষ করে আর- এস রেকর্ড ।

 সুধাংশুদা ছিলেন আমার ফ্রেণ্ড,  ফিলোজফার এবং গাইড! তিনি শিখিয়েছিলেন সরকারি চিঠির ড্রাফ্ট,ফাইল মেইনটেন -- নানান কেজো ব্যাপার। তাঁর কাছেই রপ্ত করেছিলাম জনগণেশ শুঁড় উঁচিয়ে এলে কোন কলাগাছ দিয়ে কীভাবে শান্ত করতে হবে সেই টোটকা !

    বুনিয়াদপুর তিনমাথা মোড়ে চারতলা বাড়িতে তিনতলায় আমাদের অফিস । উপরে চারতলা বাড়িওয়ালার ভদ্রাসন। দুতলায় রেজিস্ট্রি অফিস। আর একেবারে নীচতলায় সরকারি পশু চিকিৎসালয়। গো সম্পদকে সুস্থ রাখতে নিয়মিত তাদের জমায়েত হত।কাজেই অধিকাংশ দিনই গোময় ও গোমূত্রে পদযুগল স্পর্শ করে পবিত্র হয়ে তবে অফিসে প্রবেশ করতে হত। তিনতলাতে প্রয়োজনের তুলনায় ঘর কম। সিংহরায় মশাইয়ের উল্টো দিকে প্যাসেজে কার্ডবোর্ডের পার্টিশন দিয়ে আমার চাকরি জীবনের প্রথম চেম্বার তথা শুনানির হাকিমি এজলাস বানান হল এবং অবশ্যই সেনাপতি শিশিরবাবুর দায়িত্বপূর্ণ তত্ত্বাবধানে । পর্দা টাঙিয়ে দরজার অভাব পূরণ হল। আমার টেবিলের বিপরীতে শিশিরবাবু ছাড়া একজন, সুজন হলে কষ্টেসৃষ্টে বড়জোর দুজন বসতে পারে।

পরদিন থেকে খতিয়ানের নকল আর দাগের  তথ্য সই করা দিয়েই পথ চলা শুরু। তখন তো কমপিউটারের প্রচলন হয় নি। হাতে লিখেই কপি করতে হত।

কিছুদিন বাদে এই খতিয়ানের নকলে সই করতে গিয়ে এক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছিলাম।  কোনও এক রায়ত তার খতিয়ানের নকল চেয়ে আবেদন করলে সেই খতিয়ানের কপি করতে গিয়ে নজরে এল ঐ খতিয়ানের একটা দাগের অংশ-পরিমাণ লাল কালিতে কাটা। সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি বিএলআরও সাহেবের গোচরে আনা হল।উনি ফেলুদার ক্ষুদ্র সংস্করণ হয়ে খতিয়ানে ম্যাগনিফাইং গ্লাস ফেলে মৌজা ভলিউম উল্টে পাল্টে খতিয়ানে একটু ঝুঁকে বোধহয় গন্ধ -টন্ধ শুঁকে রায় দিলেন, " কোনও কেস নম্বর নেই বা কাটার পাশে অফিসারের সইও নেই । সুতরাং এটা পরিষ্কার ট্যামপারিইং। "

"গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে"-- না তখন দেবতার গ্রাস নয়, অফিস জনতার গ্রাস হবার জোগাড়! বিদ্যুৎ গতিতে অফিসে ছড়িয়ে পড়ল  এবং অতি অবশ্যই মুহুরী মহলে। তারা তাদের একতলায় নিজ নিজ "  সেরেস্তা" ছেড়ে উপরে তিনতলায় এসে কৌতূহলী প্রশ্ন ছড়াতে থাকে ( সাথে আপশোস, ' যার মাধ্যমে হয়েছে সে নিশ্চয়ই মোটা দাঁও মেরেছে !'  )। এদের মধ্যে অত্যুৎসাহী কেউ কেউ আমার ঘরের পর্দা সরিয়ে উঁকি দিয়ে,

" শুনলাম নাকি ......." , ঐ অনেকটা ধর্ষিতা মেয়ের বাপের কাছে তার মেয়ের কুশল জিজ্ঞাসার মতো। 

    অনিবার্যভাবে বিএলআরও সাহেবের ঘরে আমার আর সুধাংশুদার হাজির হওয়ার এত্তেলা এল। আমি দুরুদুরু বুকে ঢুকতেই  সুধাংশুদা মৌজা মুভমেন্ট রেজিস্ট্রার থেকে মুখ না তুলেই আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন," গত বুধবার এই মৌজা আপনার নামে ইস্যু হয়েছিল ? " মনে পড়ে গেল শিশিরবাবু কী একটা দেখাতে নিয়ে এসেছিল। বললাম, " হ্যাঁ "। এরপর ঘর নিঃশব্দ।

পরের প্রশ্ন, " দেখছি ঐ দিন খতিয়ানের নকলেও আপনি সই করেছিলেন! " জুহুরীর চোখ ছিল বটে সিংহরায়বাবুর! উল্টো দিকে চেয়ারে বিএলআরও সাহেব নির্বাক দর্শক। এবার সোজাসুজি আমার দিকে তাকিয়ে, " আচ্ছা, আপনি কি মৌজা ভলিউম খোলা রেখে তার উপরেই নকলে সই করছিলেন? " আমি তো আমতা আমতা করে তোতলাতে লাগলাম। হঠাৎ  সমস্ত নৈঃশব্দ খানখান করে ভেঙে তাঁর অট্টহাসিতে আদ্যপান্ত ঘর ভরে গেল। কোনও গোয়েন্দার রহস্য কিনারা করার পরে চরম তৃপ্তি লাভ করার মতো চেয়ারে শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, " বুঝলেন বিএলআরও সাহেব,ও সব ট্যামপারিং-টারিং কিসছু নয়। আমাদের চ্যাটার্জির খতিয়ানের নকলে লাল কালিতে সই করার সময় পেন স্লিপ করে নীচে থাকা খতিয়ানের একটা দাগের অংশ-পরিমাণ কেটে গেছে।"

এরপর যা ঘটল তা আরও চমকপ্রদ। সেদিন জানলাম আমাদের ডিপার্টমেন্টে "S " বলে একটি অমোঘ অস্ত্র আছে। গঙ্গা জলের মতো পবিত্র। যার স্পর্শে নাকি  সব অশুদ্ধের শুদ্ধিলাভ ঘটে। কমপিউটারের আগমনে আজ সেসব ইতিহাস।

 অতঃপর সুধাংশুদা ভলিউম কোলের কাছে টেনে নিয়ে পরম যত্নে লাল কাটা দাগের ওপর একাধিক " S "লিখে পাশে উনিই সই করে দিলেন।

রেকর্ড -কীপারকে মৌজা তুলে নিয়ে যেতে বলে অভয় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আমার পিঠে হাত রাখলেন, " এতো ঘাবড়াবার কিছু নেই হে ভায়া! আমরা তো আছি না কি ! চলুন আজ ওঠা যাক।" 

         অবাক হয়ে গেলাম। এমন উদারতা আর সহকর্মীদের প্রতি সহমর্মিতায় আমি আপ্লুত । আগামী দিনের জন্য ভরসা সঞ্চার করল। সুধাংশুদা আপনাকে কি ভোলা যায়?  জানিনা আজও তিনি এই পৃথিবীর আলো-বাতাস উপভোগ করছেন কিনা!

    পুরো ঘটনার শেষে বিএলআরও সাহেব শুধু "  হুম! "  বলে নাটকের উপর যবনিকা ফেলে দিলেন।

 

          ক্রমশ ( পরবর্তী অংশ দ্বিতীয় ভাগ ) 

ফেলে আসা দিনগুলি- দ্বিতীয় পর্ব 

■■■■■■■■■■■■■■■■■

 

*আজ দ্বিতীয় পর্ব: প্রথম ভাগ*

🔴🟢🟣🟡🔵🔴⚪️🟣🟡

দ্বিতীয় ভাগ। তবে মূল গল্পে যাওয়ার আগে একটু ভণিতা। এটুকু না করলে আমি নিজের কাছেই বোধহয় অপরাধী বনে যাব।না,আমি এই গৌরচন্দ্রিকার অবতারণা করে অনেকের ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছি- এমনটা যেন কেউ ঘুণাক্ষরেও মনে না আনেন।আমি আগাম ক্ষমাপ্রার্থী।

     ফেসবুকের দেওয়ালে নিয়মিত উঁকি না মারাটা আমার একটা মস্তবড় খামতি। তবুও মাঝে মধ্যে অনেকের লেখার প্রেমে পড়ে যাই। কারোর লেখায় শব্দ চয়ন ও প্রয়োগের মুন্সিয়ানা মন্ত্রমুগ্ধ করে দেয়। কেউ বা তাঁর রচনাতে পৌরাণিক কাহিনিগুলিকে স্বকীয়তার মোড়কে নতুন আঙ্গিকে মেলে ধরেন। কোনও কোনও লেখায় পারিপার্শ্বিক  বর্ণনা এত নিখুঁত যে তা বুঝি শ্রদ্ধেয় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে মনে করিয়ে দেয়। কারোর অসামান্য দক্ষতায় আঁকা ছবি আবার কেউ বা অতি সাধারণ দৃশ্যেরও অনুপম ছবি তুলে তাক লাগিয়ে দেন। সকলের এমন বিভিন্ন রকমের সৃষ্টির রসাস্বাদনের সুযোগ পেয়ে ধন্য হই, ঋদ্ধ হই। এমন সব গুণীজনের সংস্পর্শে থাকতে পারার সৌভাগ্যের জন্য মনে গর্ববোধ হয়।

       গ্রীক নাট্যকার সফোক্লেস এক জায়গায় বলেছেন, "একটি দিনের আলোর কী যে অপরূপ মহিমা, তা জানতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অপেক্ষা না করলে বোঝা যায় না।"

    তাই বুঝি চাকরি জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত হলে গোটা কর্ম জীবনের নানা অভিজ্ঞতার অনুভূতিগুলি সন্ধ্যাকাশে একটি-দুটি করে তারা ফুটে ওঠার মতো স্মৃতির ক্যানভাসে উঁকি দিতে শুরু করে।

আমার মনেহয় সকলেরই  অভিজ্ঞতার ঝুলি এমনতর নানা ঘটনার স্মৃতিতে ভরা।আমি এদের মধ্যে গুটিকয়েক আহরণ করে প্রকাশ করার সামান্য প্রয়াস করেছি মাত্র। কিন্তু সেই সামান্য প্রচেষ্টা যে এমনভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে আপনাদের ভাল লাগার আঙিনায় পৌঁছাতে সমর্থ হবে তা কল্পনাতীত ছিল। নিজের অতি সাধারণ সৃষ্টি অনেকের মন ছুঁয়ে গেছে -এর চেয়ে বড় পাওনা আর কিছু থাকতে পারে না, যেন ফুলের সুরভির মতো। আর ফুলের সৌরভ কে না পছন্দ করে!এ আমার পরম প্রাপ্তি। আমি আপ্লুত। না, সকলকে ধন্যবাদ দিয়ে  দাম্ভিক হতে চাই না। সবাইকে জানাই আমার সশ্রদ্ধ অভিবাদন।সবার জন্য রইল আন্তরিক শুভকামনা। সব্বাই খুউব ভাল থাকুন...

🙏🙏

 

*(দ্বিতীয় পর্ব,প্রথম ভাগ)*

 

*"  সত্যিই কি চেষ্টা করলেই ভোলা যায়? সে বুঝি অন্ধকার পোড়ো বাড়ির কোনও ঘরের এককোণে টিমটিম করে জ্বলতে থাকা মাটির প্রদীপের মতো । বাইরে থেকে বোঝার জো নেই।...."*

 

.       *দানপত্র*

.         ■■■■

------ প্রবীর চট্টোপাধ্যায় 

 

     " ভিতরে আসতে পারি? " 

   পর্দার ফাঁক দিয়ে বছর পঁয়তাল্লিশের এক নারীমুখ উঁকি দিল। ইসারায় সম্মতি দিলাম।

                   কয়েকদিন বাদে আবার বিএলআরও সাহেব ঘরে ডেকে নিলেন --" প্রবীরবাবু ( আমাকে ' দাদা' ' বলতে বললেও উনি কিন্তু প্রবীরবাবু বলে ডাকতেন ), এবারে  হেয়ারিং করা শুরু করুন। এখানে অনেক কেস পেণ্ডিং আছে। শিশিরবাবু অভিজ্ঞ লোক। অসুবিধা হলে আমি বা সিংহরায়বাবু তো আছিই।" সুবোধ বালকের মতো ঘাড় কাত করে সম্মতি জানিয়ে চলে এলাম।

পরদিন শিশিরবাবু  বিবর্ণ ধুলোপড়ে যাওয়া কাগজের একটা বাণ্ডিল টেবিলে রেখে আমার দিকে একটু যেন মুচকি হেসে জানালেন, " সাত ধারার কেস।" আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতে বলে উঠলেন, " ফিফটি ওয়ান এ ফোর কেস। এখানে সবাই সাতধারা বলে। হরিরামপুর মৌজা। নশো বাহান্নটা কেস। এটাতে পঞ্চাশটা আছে। হেয়ারিং করতে হবে।  নোটিসে সই করে দিন।জারি করতে হবে। " সই করছি। দেখি সুধাংশুদা পর্দা সরিয়ে ঢুকে ত্রাতা মধুসূদনদাদার মতো হাত তুলে অভয় দান করলেন - " চালু করে দিন। আরে ভায়া! কোনও সমস্যা হলে আমি তো আছি।"

    মাসখানেক পর। বোধহয় সোমবার । শিশিরবাবু সকালে এসেই সাবধান বাণী শোনালেন,"  স্যার,  দুশো তেরো থেকে দুশো ষোলো  নম্বর কেস পরে হেয়ারিং করবেন।একটু ঝামেলা আছে।" আমি কারণ শুধানোর আগেই উধাও হয়ে গেলেন । খানিকক্ষণ পরে শুনানি শুরু হল। একশো বিরানব্বই নম্বর কেস। আবেদনকারিনী সোহাগী বালা দাসীর পক্ষে ভাইপো হাজির। দানপত্র দলিল ও খতিয়ান দৃষ্টে দেখা গেল চারশো বাইশ খতিয়ানের  রায়ত হরিশ্চন্দ্র রায় তার বাইশটা দাগের পাঁচ একর নব্বই শতকের মধ্যে বাহান্ন দাগের বত্রিশ শতক জমি আবেদনকারিনীকে নিঃশর্তে দানপত্র করে দিয়েছে। হঠাৎ কুড়ি-বাইশ বছরের একটি ছেলে পর্দা সরিয়ে মাথা গলাল,

-- " স্যার, ভিতরে আসতে পারি?"

---- " আসুন ।কী চাই বলুন ।", আমি উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাই। লক্ষ্য করলাম তার পিছনে আরও কয়েকটি মাথা।

---- " যে কেসের শুনানি হচ্ছে সেই দলিল ভুয়ো । আমার বাবা  কখনওই এ দলিল করে নি।"

          এবার পেছনের মাথারা যোগ দিয়ে সমস্বরে চিৎকার করতে লাগল, "এ কেস বাতিল করতেই হবে।"  যুক্তি -পাল্টা যুক্তিতে অনেকগুলো গলা চড়তে লাগল। যদিও একা, ভাইপোও কেসের স্বপক্ষে বলতে লাগল। শিশিরবাবু কিছু বোঝাতে গেলেন ,তবে সুবিধা হল না। মনে  হয়েছিল উনি সত্যিটা জানতেন।এমন সময় মুসকিলআসান সুধাংশুদার প্রবেশ। ভারিক্কি হাকিমি গলায় বলতে লাগলেন, " আর- ও-  সাহেব যা বলেছেন তা এক্কেবারে ঠিক ও আইনসম্মত। কোনও দলিল সঠিক না ভুয়ো , সে বিচার একমাত্র মহামান্য আদালতই সাব্যস্ত করতে পারেন, আমরা নই।কাজেই এ কেসের পক্ষেই রায় হবে। "

     তারা এবার দলবেঁধে বড় সাহেবের কাছে গেল এবং অবধারিত ভাবে আমার ডাক পড়ল।আমার সাথে সুধাংশুদাও তাঁর ঘরে ঢুকে তাঁকে বিস্তারিত ভাবে বুঝিয়ে সিদ্ধান্তের কারণও জানিয়ে দিলেন। বিএলআরও সাহেবে তাঁর সঙ্গে একমত হলেন। নিম্ন আদালতের রায়ই বহাল হয়ে গেল দেখে তারা সুড়সুড় করে চলে গেল।

বিকেলে দুশো তের থেকে দুশো ষোলো দরখাস্তের শুনানিতে জানা গেল চারজন ওয়ারিশ রেখে  উক্ত হরিশ্চন্দ্র রায় গত হওয়ায় তারাই  তার খতিয়ানভূক্ত জমি ওয়ারীশ হিসেবে রেকর্ড করাতে আবেদন করেছে। যথারীতি  ঐ খতিয়ানের পড়ে থাকা বাকি জমি চারজনের নামে নথিভুক্ত হয়ে গেল।

     সেদিন সকালে সামান্য এক পশলা বৃষ্টি হয়ে সারাটা দিন আকাশ আর মেঘের ঘোমটা খুলল না। হেয়ারিং নেই। চাপ কম। ইশারায় সম্মতি দিতে দেখলাম সস্তা চটিজোড়া একপাশে খুলে রেখে পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকল। উত্তরবঙ্গের একাধিক জেলায় কর্মরত থাকতে খেয়াল করেছি অধিকাংশ মানুষই ঘরে ঢোকার আগে বাইরে জুতো বা চটি রেখে আসত। তা সংস্কার বোধে না সম্মান দেখান ,সেটা অজানা ছিল।

 ইশারায় সামনের চেয়ারে বসতে বললাম। পরপুরুষের সামনে সম্ভ্রম রেখে সসঙ্কোচে বসল। সারা মুখে অতি সাধারণ দিন যাপনের ছাপ। শীর্ণকায় হাত।তার একটিতে দু-গাছা চুড়ি, হয়তো মনোহারি দোকান বা মেলায় কেনা। ফসল কাটার পরে হেমন্ত শেষে  খেতিজমির মতো নিষ্প্রাণ বিবর্ণ  সীমন্ত রেখা। পরনে মিলের কমদামী শাড়ির সাথে মানানসই রঙ জ্বলে যাওয়া ব্লাউজ। মাথা ঝুঁকিয়ে বাঁ হাতের তর্জনীর রূপোর আঙটি ডান হাত দিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে বলল," আমার নাম সোহাগী বালা দাসী ।" এরকম কতই ' দাস'  বা ' দাসী ' আসে যায় ! তাই জিজ্ঞাসা করলাম, " কী দরকার বলুন।" 

এবার সামান্য মাথা তুলল, " আপনি আমার বাবার মতো। আপনার উপকার কোন দিন ভুলতে পারব না । ভাইপো অপূর কাছে সব শুনেছি।" ভাবতে লাগলাম। একটু হাসিও পেল বিয়ে না করেই বাবা হলাম বলে। ঠিকমতো বুঝতে না পেরে তাকিয়ে আছি দেখে যোগ করল," সপ্তা দুই আগে হরিরামপুর মৌজার সাত ধারা কেস ছিল। শুনেছি হরিবাবুর ছেলেরা খুব ঝামেলা করেছিল যাতে না হয়। আপনি না থাকলে কী যে......."  

(চলবে...)

ফেলে আসা দিনগুলি...
♥♥♥♥♥♥♥♥
আজ দ্বিতীয় পর্ব (শেষ ভাগ )
🔹🔹🔹🔹🔹🔹🔹🔹



দ্বিতীয় পর্বে প্রথম ভাগের পর...
এবারে সব ঘটনা মনে পড়ে গেল। আমি বাধা দিয়ে বললাম, " না না , এভাবে বলার কিছু নেই। এটা তো আমাদের দায়িত্ব বা কাজের মধ্যেই পড়ে ।"
" তা হলেও সেদিন আপনি আমার মতো গরীবের জন্য অনেক করেছেন , না হলে পথে বসতে হত " , ধন্যবাদ জানানোর মতো করে বলল। এরপর চুপচাপ হয়ে গেল ।
হঠাৎ মাথায় কৌতুহল চেপে বসল, " যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে পারি ?"
-- " আপনি হাকিম মানুষ । আপনার কথার উত্তর দেওয়া তো কততব্য ! "
" আচ্ছা, উনি আপনাকে দানপত্র লিখে দিলেন কেন ? ছেলেরা তো দাবি করল আপনি ওদের কেউ হন না।"
শুনে মেঝের দিকে তাকিয়ে অন্য হাতের আঙুল দিয়ে আংটিটা ঘোরাতে লাগল। খানিকবাদে উপরে ফ্যান ঘোরা দেখতে লাগল। এরপর আস্তে আস্তে শুরু করল,
---" সে অনেক পুরনো কথা।" আমি উৎসাহ নিয়ে টেবিলে একটু ঝুঁকলাম।এক মুহূর্ত থেমে যেন আর্তনাদ করে উঠল," বিশ্বাস করুন, আমি নিজে থেকে কিন্তু একদম চাইনি! " আমি কিছু বুঝতে না পেরে অপার বিস্ময়ে চেয়ে রইলাম দেখে মূল কাহিনি শুরু করল, " আমরা এক বোন দুই ভাই। বাবা মারা গেছেন। বড়দার সংসারে আছি। আর এক ভাইয়ের পরিবারেও দাদাকে সাহায্য করতে করতে হয়। নাইন অবধি পড়ে আর স্কুলে যাওয়া সম্ভব হয়নি। আমাদের গ্রাম থেকে মাইল খানেক দূরে হীরুদাদের পৈতৃক বসতবাড়ি। আমার বড়দার খুব বন্ধু। বাড়িতে আসা-যাওয়ার সুবাদে আস্তে আস্তে আমাকে ভাল লেগে যায়। আমিও একদিন না দেখলে ছটফট করতাম। কিন্তু কথা বলার সুযোগ হত না। এভাবে অনেক দিন কেটে গেল। একবার বারুণীর মেলায় বন্ধুদের সাথে যাওয়ার ছলে লুকিয়ে দেখা করলাম। আশ মিটিয়ে মনের কথা বললাম। হীরুদা আমায় নিয়ে ঘর বাঁধতে চায়। আসার সময় রঙিন চুড়ি, ফিতে, টিপের পাতা--- কত কী যে কিনে দিল! এভাবে মাঝে-সাঝে নানা মেলা বা পুজোতে দেখা করতাম। এমনি করেই কয়েকটা বছর কেটে গেল।দাদা-বৌদি এক প্রকার নিশ্চিতই ছিল যে হীরুদা আমায় ঘরে তুলবে।" এই পর্যন্ত বলে থামলেন। গুমোট গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। টেবিলে আশেপাশে তাকিয়ে কিছু যেন খুঁজছেন । বললাম ,"জল খাবেন? " ঘাড় নেড়ে চাইল। গ্রুপ ডি বাবলুকে ডাকলাম। গ্লাসের পুরো জলটা গলায় ঢেলে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছে নিল। আবার আংটিটা ঘোরাতে ঘোরাতে ডান পা দিয়ে মেঝেতে মৃদুভাবে ঘষতে লাগল। পুনরায় শুরু করলেন , " বেশ কিছুদিন হীরুদা এল না। এরপর একদিন হঠাৎ সন্ধ্যায় এল। দেখা হল। কিন্তু আমায় দেখেও না দেখার ভান করল। দাদার সাথে কী সব দরকারি কথা বলে চলে গেল। আমার মনে যেন কু ডাকল। রাতে ঘুম আসল না। পরদিন বৌদির কাছে সব জানলাম। একমাত্র ছেলে হীরুদা।তার বাবা এই সম্পর্ক মেনে নিতে চায় না।অন্য জায়গায় তার বিয়ে ঠিক করেছে। যা কিছু রোজগার তা তো জমি থেকে। বাবার ত্যজ্যপুত্র হওয়ার হুমকিতে এই বিয়ে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।" একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বাইরে উঁকি দিয়ে দেখলাম তখনও উদাসীন মেঘলা আকাশ।
" খুব কষ্ট হল কদিন। কিচ্ছু খেতে পারতাম না। লুকিয়ে কাঁদতাম। আমি যে অভাগী! ধীরে ধীরে সয়ে গেল। বাড়িতে বলে দিলাম আমার যেন বিয়ের কথা না হয়। তবুও দাদা কটা সম্বন্ধ এনেছিল ।কিন্তু তাদের যা খাঁই, দাদার যা আয় তাতে তা দেওয়া সম্ভব ছিল না । ভাইপো - ভাইঝিদের নিয়ে দাদার সংসারে এই তো বেশ আছি!"
সামান্য বিরতি নিয়ে,
-- " ধীরে ধীরে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। " , বলে আমার চেয়ারের পিছনে দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারে দুটো হাসিখুশি বাচ্চার ছবির দিকে উদাস চোখে চেয়ে রইলেন।
সত্যিই কি চেষ্টা করলেই ভোলা যায়? সে বুঝি অন্ধকার পোড়ো বাড়ির কোনও এক ঘরের এক কোণে টিমটিম করে মাটির প্রদীপের মতো জ্বলতে থাকে।বাইরে থেকে বোঝার জো নেই।
আরও জানার ইচ্ছে ছিল।কিন্তু কৌতূহল থাকা ভাল, তবে তাকে একটা নির্দিষ্ট সীমারেখায় আটকে রাখা উচিত ।
ওনার কথায় সম্বিত ফিরল,
" দাদা একদিন আমায় ডেকে বলল , ' কাল আমার সাথে তোকে একটু গঙ্গারামপুরে রেস্ট্রি অফিসে যেতে হবে।' একবার ভাবলাম কারণটা জিজ্ঞাসা করি। কিন্তু দাদা খুব রাশভারি মানুষ। সাহস হল না। পরদিন দাদা নিয়ে গেল।শুনলাম ঐ অফিসে জমিজমার দলিল-টলিল লেখা হয়। আমাকে দিয়ে কী সব সই-টই করান হল। একসময় হঠাৎ হীরুদাকে দেখতে পেলাম। দেখলাম দূরে দাদার সঙ্গে কথা বলে একটু পরেই চলে গেল। খুব ইচ্ছে হলেও অভিমান করে কথা বললাম না।"
একদমে বলে একটু থামল। আবার ধরল," দিনকয়েক বাদে বৌদির কাছে জানতে পেরেই সোজা গেলাম দাদার কাছে। যেতেই দাদা বলল,' আমি জানি তুই আপত্তি করবি। সোনা বোন আমার! রাগ করিস না। শোন। এই দানপত্র লিখে দেওয়ার আগে হীরু ক' বার হাটখোলায় আমার আড়তে গেছে। আমি বারণ করেছি। ও নাছোড়বান্দা! যুক্তি দেয়-- দ্যাখ নবা, তুই আমার ছোট্ট বেলার বন্ধু। সোহাগীর তো বিয়ে -থা হল না। তোর নিজের সংসারের বোঝা তার ওপর সোহাগী। ওর ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমায় তুই ফিরিয়ে দিস না। আমার অপরাধ ভগবান কোনও দিন ক্ষমা করবে না জানি। এই কথা বলে হীরু আড়ত থেকে চলে গেল। আমিও আর না বলতে পারিনি। ও তোকে সত্যিই ভালবাসত রে ! তুই বল আমি কি ভুল করেছি? ' আমি একথার উত্তর দিতে পারিনি।"
আবেগে বাষ্প গলায় দলা পাকিয়ে শেষের দিকে তাঁর কথাগুলো বেশ ভারী শোনাল।
অনেকদিন হয়ে গেল।প্রায় ত্রিশ বছর ।এরই মধ্যে টাঙন,পুনর্ভবা, তিস্তা আর গঙ্গাতে বহু জল গড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় নানা ধাপ পেরিয়ে আজ মহকুমার হাল ধরলেও সেইসব ফেলে আসা দিনেরা আজও চোখের সামনে সেলুলয়েডে ধরে রাখা মুভির মতো জীবন্ত হয়ে ভেসে ওঠে।
এতক্ষণ মাথা নীচু করে বলে যাচ্ছিলেন।খানিক নিস্তব্ধতার পর ঝুঁকে থাকা মাথা সামান্য তুলে চোখে নীরবতার ভাষায় আমার সামান্য বিধিবদ্ধ দায়িত্ব পালনকে অসামান্য রূপে স্বীকৃতি দিলেন।
ওঠার সময় দেখলাম তার দুটি চোখের কোণে কৃতজ্ঞতার অশ্রু চিকচিক করছে। ঘর থেকে বেরিয়ে চটি জোড়া পড়ে ধীর পায়ে চলে গেলেন। ঠিক তখনই সারাদিন ধরে আকাশের বুকে জমে থাকা মেঘলা অভিমান যেন বৃষ্টি হয়ে ঝরতে লাগল।

© ---- প্রবীর চট্টোপাধ্যায়

(চলবে)

ফেলে আসা দিনগুলি
🔹🔹🔹🔹🔹🔹

তৃতীয় পর্ব
■■■■■

. নামাবলি
. 🔴🔵🔴

অফিস বুনিয়াদপুরে।ব্লকের নাম বংশীহারি।তা সে না হয় হল !কিন্তু মাথা গোঁজার কী ব্যবস্থা হবে? কলকাতা থেকে তো 'ডেলি পাষণ্ড' হয়ে রোজ যাতায়াত করা শুধু মুশকিলই নয়,' না মুমকিন ' ও বটে! তবে সেই কাহিনির ফিতে একটু একটু করে পরে খুলছি।
ছোট্টবেলা থেকেই আমার অদম্য কৌতূহল, যখনই কোনও নতুন জায়গায় গিয়ে উঠি, সেখানকার ঐ নামকরণের উৎসটা জানার।বিভিন্ন জায়গা থেকে যা টুকরো-টাকরা খুঁজে পেয়েছি তা দিয়ে বানানো।আমি ইতিহাসবেত্তা নই।তাই ভুলত্রুটি থাকতেই পারে। আমি অগ্রিম ক্ষমাপ্রার্থী।
দেশভাগের পর পূর্বতন দিনাজপুরের একটি অংশ পূর্ব পাকিস্তানে ( অধুনা বাংলাদেশ ) রয়ে যায় আর যে অংশটি পশ্চিমবঙ্গের ভাগে পড়ে তা পশ্চিম দিনাজপুর নামে অভিহিত হয়। এই সাবেক পশ্চিমদিনাজপুর উনিশশো বিরানব্বই সালের পয়লা এপ্রিলে দুভাগে বিভক্ত হয়ে উত্তর দিনাজপুর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার সৃষ্টি হয়।
বিখ্যাত ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন যে প্রায় আড়াই হাজার বছরব্যাপী সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ দিনাজপুর ক্রমান্বয়ে মৌর্য ,শুঙ্গ,পাল, সেনযুগের রাজাদের থেকে পরবর্তী কালে মুসলিম শাসকদের অধীনে ছিল।
🔷দিনাজপুর :: দিনাজপুরের নামকরণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যে রাজার নাম জড়িয়ে তিনি হলেন রাজা গণেশ।তিনি ছিলেন ভাতুরিয়ার ( অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত ) সামান্য এক জমিদার। মধ্যযুগীয় ইতিহাসবিদ ফেরিস্থার মতে, কালক্রমে গণেশ ঐশ্বর্যবান ও প্রবল ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন এবং মুসলমান শাসক আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহকে পরাস্ত করে সিংহাসনে বসেন।সিংহাসনে আরোহণ করার কিছু পরে রাজা গণেশ " দনুজমর্দনদেব" উপাধি গ্রহণ করেন।কালে কালে ' দনুজ' শব্দ থেকে 'দিনাজ' এবং স্থানবাচক 'পুর' মিলে এই অঞ্চলের নাম হয় দিনাজপুর। রাজা গণেশ শুধু "দনুজমর্দনদেব " উপাধি নিয়েই ক্ষান্ত হননি, তিনি এই নাম রেখে মুদ্রারও প্রচলন করেছিলেন।
আরেকটি মতবাদ হল গৌড়েশ্বর গণেশ মসনদে আসীন হওয়ার কিছু দিন পরে দীনরাজ ঘোষ নামে তাঁর এক প্রিয় বন্ধুকে খুশি হয়ে এক বিস্তৃত ভূখণ্ড উপহার দেন।এই দীনরাজ -এর নামানুসারে অঞ্চলটির নাম হয় ' দীনরাজপুর ' এবং ক্রমে লোকমুখে স্থানীয় কথ্য ভাষায় রূপান্তরিত হতে হতে দিনাজপুর নাম ধারণ করে। Buchanan Hamilton সাহেবের বিবরণেও এমন তথ্য মেলে।
🔷গঙ্গারামপুর :: এই অঞ্চলে শ্রীরামচন্দ্রের লোকপ্রিয়তার আবহে এবং পালরাজাদের অনুপ্রেরণায়,পাল যুগে বিখ্যাত কবি কবিরত্ন সন্ধ্যাকর নন্দী " রামচরিত " রচনা করেন। এই গ্রন্থে বর্ণিত, লোক বিশ্বাস -একদা দেবী গঙ্গা ও শ্রীরামচন্দ্র শ্রীকৃষ্ণ ধন্য বাণগড়ে [ *কথিত আছে বলিরাজপুত্র বাণাসুর বাণপুর প্রতিষ্ঠা করে। পুরাণ মতে বাণাসুর কন্যা ঊষার সঙ্গে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধের প্রেমপর্বকে কেন্দ্র করে বাণাসুর ও শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক বাণাসুর নিহত হয়।ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের মতে পুনর্ভবা তীরের কোটীবর্ষ ও পুরাণকথিত বাণপুর যা কিনা দিনাজপুরের বাণগড় ( বর্তমানে গঙ্গারামপুরে) বলে পরিচিত।* ]পদার্পণ করে পুনর্ভবা নদীর সৌন্দর্যে মোহিত হন।তখন গঙ্গা নিজ ধারা দিয়ে এই নদীকে মাহাত্ম্য দান করেন। এই জন্য জন বিশ্বাসে পুনর্ভবা ছিল বরেন্দ্রভূমির গঙ্গা। রামচরিতে রাজা রামপালকে শ্রীরামচন্দ্রের সাথে তুলনা করা হয়েছে। কথিত আছে( খননে তাম্রলিপিও পাওয়া গেছে )রাজা প্রথম মহিপাল মতান্তরে রামপাল এক পৌষ সংক্রান্তিতে গঙ্গারূপী পুনর্ভবা নদীতে স্নান করে পুণ্য অর্জন করতে দক্ষিণা স্বরূপ এক ব্রাহ্মণকে একটি বড় গ্রাম দান করেন যা ক্রমে ক্রমে গঙ্গারামপুর নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে।
🔷বংশীহারি :: বংশীহারি নাম কীভাবে হল কিছুতেই জানা যাচ্ছে না। অবশেষে খুঁজতে খুঁজতে হাজির হলাম রায়গঞ্জে।
বর্তমান রায়গঞ্জের অতীতে নাম ছিল ' রাইগঞ্জ '।অবাক হওয়ারই মতো। এবার সেই গল্পে যাওয়া যাক।
মুঘল সম্রাট আকবর শাসনকার্যে সুবিধার জন্য বাংলা প্রদেশকে পনেরোটি সুবায় ভাগ করেছিলেন। এদের মধ্যে "হাভেলি পঞ্জারা " সুবার অন্তর্ভুক্ত ছিল এই দিনাজপুর। "হাভেলি পঞ্জারা " সুবা আবার কতকগুলি পরগণায় বিভক্ত ছিল। অতি প্রাচীনকালে প্রশস্ত কুলিক নদীর নাব্যতা এতটাই ছিল যে তাকে কেন্দ্র করে কুলিক বন্দর গড়ে উঠেছিল। আজ আর কোনও অস্তিত্ব নেই।এই কুলিক নদী সংলগ্ন কুলিক বন্দরসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলই ' সুজানগর' পরগণা যা কিনা অধুনা রায়গঞ্জ। রায়গঞ্জে পুরনো জমির তথ্য অর্থাৎ সি. এস. পরচা বা ঐ ধরণের কাগজে না কি সুজানগর নামটি এখনও মেলে।
বাংলা প্রদেশের তৎকালীন শাসনকর্তা হুসেন শাহের আমলে সমগ্র উত্তরবঙ্গ জুড়েই ধর্মীয়,সামাজিক, অর্থনৈতিক -- নানা অরাজকতার সৃষ্টি হতে থাকে।একদিকে মুসলিম শাসক নবাবের প্রশ্রয়ে লালিত রুচিহীন ধর্মান্ধ মুসলমান সম্প্রদায় আর অন্য দিকে গোঁড়া ও শাস্ত্রজ্ঞান রহিত ব্রাহ্মণ সমাজ---- এই উভয় দলের উৎকট ধর্মীয় উন্মাদনা আর লোভী আত্মসিদ্ধিলাভ প্রসুত সামাজিক অত্যাচারে অতিষ্ঠ সমাজের নিম্নবর্গের মানুষগুলোর অস্তিত্ব সাংঘাতিকভাবে বিপন্ন হয়ে পড়ে।দলে দলে এইসব অন্ত্যজ হিন্দুরা ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করতে উৎসাহিত হতে থাকে।
এমনই এক মহা সংকটকালে রামকেলিতে চৈতন্য মহাপ্রভুর উদয় ঘটে। মালদহ জেলার ইংরেজ বাজার থানার অন্তর্ভুক্ত একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম রামকেলি।মহাপ্রভু সনাতন বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার করতে থাকেন এবং সেই প্রচারিত ধর্মের মাহাত্ম্যে হরিনামের জোয়ারে সমগ্র উত্তরবঙ্গ ভেসে গেল।বৈষ্ণব ধর্মে আস্থা রেখে ঐসব ধর্মান্তরিতরা আবার হিন্দুধর্মে ফিরে এল।
স্বয়ং হুসেন শাহ মহাপ্রভুর প্রচারে অনুপ্রাণিত ও মুগ্ধ হয়ে বৈষ্ণব ধর্মের একজন প্রধান পৃষ্ঠপোষক হয়ে পড়েন।শুধু তাইই নয়,হুসেন শাহের দুই সেনাপতি - সাকিরউদ্দিন ও দবিরউদ্দিন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে স্বয়ং মহাপ্রভুর কাছে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হন,যাঁরা পরবর্তীকালে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর দুই প্রধান শিষ্য - রূপ গোস্বামী ও সনাতন গোস্বামী নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। বৈষ্ণব ধর্মের অনিবার্য প্রভাবেই সুজানগর পরগণা কালক্রমে "রাই (রাধা)গঞ্জ " রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এই 'রাইগঞ্জ ' মুখে মুখে অপভ্রংশ হয়ে রায়গঞ্জ নাম লাভ করে।
একইভাবে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিও সনাতন বৈষ্ণব ধর্মের মহিমায় প্রভাবিত হয়ে যথাক্রমে রাধিকাপুর, বংশীহারি, কিষাণ (কৃষ্ণ)গঞ্জ ইত্যাদি নামে একে একে পরিচিতি লাভ করতে থাকে।
অধিকাংশ গবেষকই এই মতবাদ পোষণ করে থাকেন।
🔹বুনিয়াদপুর :: বুনিয়াদপুর থেকে প্রায় সাত কিমি দূরে বড়গ্রাম রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ।তৎকালীন বর্ধিষ্ণু রাজা বা জমিদারদের জমিদারি ছিল বড়গ্রামে।লোকশ্রুতি বলে, বড়গ্রাম নাম থেকেই সমগ্র অঞ্চলটি বুনিয়াদপুর রূপে খ্যাত হয়,যদিও এমন ধারণার পিছনে তেমন কোনও প্রামাণ্য তথ্য মেলে না।
🔹কালিয়াগঞ্জ :: Buchanan Hamilton তাঁর "প্রাচ্যভারত" গ্রন্থে বলেছেন, দিনাজপুরের এক বিস্তৃত অঞ্চল জনৈক কাশী নামে এক ব্যক্তির আয়ত্তাধীন ছিল।তার নাম আজ বিস্মৃতির তলে।কিন্তু তাঁর সমাধি হিসেবে রাজবাড়ির মন্দিরকেই লোকে জানে।জনশ্রুতি যে তিনি একজন ধর্মপ্রাণ ব্রহ্মচারী ছিলেন এবং সেখানে কালীঠাকুরের একটি মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন যা কালিকা নামে পরিচিত হয়। এই দেবী মূর্তি আজও পূজিতা হন। কথিত আছে কালিকা দেবীর মন্দির থেকেই ঐ অঞ্চলটি কালিয়াগঞ্জ নামে অভিহিত হয়।
🔹তপন ব্লক:: তপন দিঘি থেকেই এই ব্লকের নামকরণ।কথিত আছে দিনাজপুরে সেন বংশের রাজত্বকালে রাজা লক্ষ্মণ সেন তাঁর পূর্বপুরুষদের তর্পনকার্যের জন্য দু কিমি দৈর্ঘ্য ও এক কিমি প্রস্থের এই বিশাল দিঘিটি খনন করান।নাম হয় তর্পনদিঘি।কালক্রমে এই 'তর্পন' দিঘি লোকমুখে অপভ্রংশ হয়ে তপন দিঘি নামে পরিচিতি লাভ করে।
পালবংশের রাজারা বৌদ্ধধর্মের গুণমুগ্ধ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।তাঁদের আনুকূল্যে অনেক বৌদ্ধবিহার গড়ে উঠেছিল। এই জেলায় ইটাহার, ময়াহার ভিকাহার ইত্যাদি স্থানের নামের উৎস সন্ধানে তাইই মেলে।আরও জানা যায় এই পাল রাজারা প্রজাদের মঙ্গলের জন্য একাধিক কূপ ও দিঘি খনন করান।রাজা মহীপালের নামানুসারে মহীপাল দিঘি।এছাড়া আলতাদিঘি,মালিয়ান দিঘি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
দিঘির নাম বলতেই গঙ্গারামপুরের কথা মনে পড়ে গেল।একটি মধুর প্রেমকাহিনি দিয়ে আজকের পর্ব শেষ করব।
জনশ্রুতি আছে, বাণগড়ে (অধুনা গঙ্গারামপুর ) বাণাসুর তথা বাণরাজার দুই পরমাসুন্দরী রানি ছিলেন -- একজন গৌরবর্ণা এবং অপর জন শ্যামবর্ণা। একদিন রাজার প্রাণপ্রিয়া দুই রানি রাজার সংলগ্না হয়ে তাঁর কাছে আবদার করে বসেন যে তিনি যেন তাঁদের জন্য স্মারক রূপে এমন কিছু নির্মাণ করে যান যাতে যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে গাঁথা থাকে। রাজনির্দেশে এখানে দুটি বিশাল দিঘি খনন করা হয় --ধলদিঘি ও কালদিঘি। আজও গঙ্গারামপুরে এই জোড়া দিঘি রানিদের স্মৃতি বহন করে চলেছে।
( ক্রমশ )

*ফেলে আসা দিনগুলি*
♥️♥️♥️♥️♥️♥️♥️
চতুর্থ পর্ব
■■■■■

আলতা দিঘির আলতো প্রেমের গল্প ....
💖💜💝💘💙💛💜💚💗💘
আমার অনুজ ও ভ্রাতৃপ্রতিম তথাগত দাস (ADA) আলতা দিঘি ( ৮০.৪৮ একর ) ও গৌড় দিঘি ( ৫৮.০৯ একর)-র বিষয়ে কৌতূহল প্রকাশ করেছে।জানতে চেয়েছে তাদের নামকরণের উৎস। তবে গৌড়দিঘি নয়,আলতা দিঘি নিয়ে কিছু রসদ পেলাম।কিন্তু মুশকিল হল,কোনও প্রামাণ্য নথি বা তথ্য নয়।বংশীহারি ব্লকে শিশিরবাবুর পর একসময় আমার সহকারী হিসাবে ছিল পল্লব ব্যানার্জি।সুঠাম,সপ্রতিভ,ঝকঝকে, গৌরাঙ্গ ও দীর্ঘদেহী।বাড়ি হরিরামপুর।এটা তখনও দক্ষিণ দিনাজপুরের স্বতন্ত্র ব্লকের স্বীকৃতি পায়নি। একাধিকবার আমাকে নিয়ে গিয়েছে।এক পেটুক বামুন আর এক ভোজনরসিক বামুনের অতিথি।ব্যাপারটা মন্দ নয়।পেটের পক্ষে কিন্তু গ্রেট ! যাইহোক,পল্লব আমাকে অনেক ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্য স্থানে নিয়ে গিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল।ওখানে গ্রামের কয়েকজন প্রাচীন মানুষের কাছে তখনকার সেই শোনা কথা, বর্ষাকালে পুরনো আচারের মতো ফিরে এল। এরই ওপর ভিত্তি করে এ কল্পকাহিনি বানানো।আসুন,শোনা যাক সেই উপাখ্যান......
সমগ্র দিনাজপুর বরেন্দ্র ভূমি অঞ্চল বলে পরিগণিত।ভূমির ধরণ রুক্ষ প্রকৃতির।অধিকাংশ জায়গায়
চাষাবাদ এবং পানের জন্য সারা বছরব্যাপী প্রয়োজনীয় জলের অভাব। এমনই আবহে এ গল্পের সৃষ্টি ......
কোনও এক সকালে মহারাজের তলব পড়ল মহারানির খাস অন্তঃপুরে। মহারাজ প্রবেশ করে সোনার পালঙ্কে উপবেশন করলেন। রানি সোনার নথ আর সোনার কঙ্কণ নাড়িয়ে মহারাজের পানে অনুযোগ আর আবদারের দৃষ্টি হানে,
---- মহারাজ !
প্রিয়ার মুখমণ্ডলে মেঘ জমতে দেখে কবে কোন্ পুরুষ হৃদয় আর স্থির থাকতে পেরেছে! রাজা শশব্যস্ত হয়ে পড়লেন,
----- বলো রানি? কী অভিপ্রায়ে এমন সাত-সকালে আমার তলব?
আরও একটু গাঢ় হয়ে এসে রানি নিবেদন করে,
---- স্বপ্নাদেশ! মহারাজ স্বপ্নাদেশ!
ঘোরতর অমঙ্গলের আশঙ্কায়
রাজা বিস্ফারিত চোখে চেয়ে বলে উঠলেন,
----- স্বপ্নাদেশ! কেন রানি?কীসের স্বপ্নাদেশ?
রানি এখন কিছুটা ধাতস্থ হলেন,
------ গতকাল রাতে রাজবাড়ির গৃহ দেবতা আমায় স্বপ্নাদেশ দিয়েছেন যে আগামী চৈত্র সংক্রান্তির পূর্বেই আপনাকে মস্ত এক দিঘি খনন করাতে হবে।
---- দিঘি খনন করাতে হবে? কিন্তু কেন ?
---- মহারাজ! আপনার প্রজাদের মঙ্গলের জন্য। স্বপ্নাদেশে এটাও বলা হয়েছে যে এর অন্যথা হলে প্রজাদের ভয়ানক অকল্যাণ হবে।এমন কী এই রাজবাড়িও তার হাত থেকে রক্ষা পাবে না।
লম্বা শ্বাস নির্গত করে রানিকে এখন অনেক নিশ্চিন্ত দেখাল। একটু থেমে মহারাজের চোখে বড় বড় চোখ মেলে রানি আবার শুরু করলেন,
----- তবে এই দিঘি খননে একটা শর্ত আছে।
এবার সত্যিই অবাক হওয়ার পালা। রাজা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে,
----- শর্ত! কী সেই শর্ত?
----- হ্যাঁ,শর্তটা এই যে আগামী শুক্লপক্ষের মধ্যেই সূর্যোদয়ের আগে ভোরবেলায় আমাকে খালি পায়ে জমি বরাবর পূর্ব দিকে হাঁটতে হবে,যতক্ষণ না আমার পা ফেটে গিয়ে রক্তাক্ত হয় এবং যেখানে হবে সেই অবধি দৈর্ঘ্য বরাবর দিঘি খনন করাতে হবে।
রাজা ও রানি- উভয়েই গভীর উৎকণ্ঠায় নতমস্তক রইলেন।
তখনকার দিনে সাধারণ মানুষ মায় রাজা-জমিদাররাও স্বপ্নের মাধ্যমে দেবাদেশকে ভয় ও ভক্তিতে সাংঘাতিকভাবে মেনে চলতেন।
কোনও তুচ্ছ ব্যাপার নয়।স্বপ্নাদেশ বলে কথা! তায় আবার প্রাণাধিক মহারানির উপর। সুতরাং পরদিন থেকেই রাজদরবারে সাজ সাজ রব। রাজামশাই মন্ত্রী,খাজাঞ্চি, সভাসদমণ্ডলী- সকলের সাথে ঘনঘন সভা করতে লাগলেন।এত্তেলা দিয়ে রাজজ্যোতিষীকে রাজসভায় আনানো হল।তিনি নাকের ওপর পুরু কাচের চশমা ঝুলিয়ে ,কয়েক টিপ নস্য গুঁজে,মাথার পিছনে লম্বা টিকি দুলিয়ে,পাঁজিপুঁথি দেখে শুভ দিনক্ষণের বিধান দিলেন।এরপর নির্দিষ্ট দিনে ঊষালগ্নে সৈন্য-সামন্ত- পাইক- বরকন্দাজ -লেঠেল- লোক -লস্কর-সখী আর পরিচারিকামণ্ডলী সমভিব্যাহারে মুক্ত পদে মহারানি পূর্বাভিমুখে পদব্রজে চললেন। কিন্তু তিনি যাচ্ছেন তো যাচ্ছেনই।না আছে থামার কোনও লক্ষণ, না দেখা গেল পায়ে রক্তক্ষরণ। বিচক্ষণ মন্ত্রীমশাই মুহূর্তে প্রমাদ গুনলেন।এভাবে রানিমা চলতে থাকলে মহারাজের পক্ষে সেই অপরিমেয় আয়তনের দিঘি খনন করানো যে অসম্ভব! তিনি রাজামশাইয়ের গোচরে না এনে অন্য সভাসদদের সঙ্গে পরামর্শ করে রানিমায়ের প্রধান পরিচারিকাকে কিছু নির্দেশ দিলেন। কিছুক্ষণ পর সকলের কোলাহলে জানা গেল,রানিমায়ের পা রক্তাক্ত।রানিমা ভূমিতে বসে পড়েছেন।
মন্ত্রীমশাইয়ের বিচক্ষণতায় আর প্রত্যুপন্নমতিত্বে প্রধান পরিচারিকা রানিমায়ের পায়ে কৌশলে আলতা লাগিয়ে না দিলে ওই দিঘি হয়তো সৃষ্টি হতো না। হয়তো সৃষ্টি হতো না প্রজাদের হিতার্থে মঙ্গলময়ী এক রাজমহিষীর স্বপ্নের দিঘি খনন। ক্রমে ক্রমে রানিমায়ের স্মৃতিবিজড়িত সেই বিশাল দিঘি" আলতাদিঘি " নামে খ্যাত হয়।
না,এই কাহিনির কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। জনশ্রুতি মাত্র।কিন্তু যদিও জনশ্রুতি তবুও গল্পটি থেকে কিছু অনুমান করা যায়।
এটা কোনও এক পাল বা সেন বংশের রাজার রাজত্বকালের ঘটনা হতে পারে,অবশ্য যদি সত্যিই তা ঘটে থাকে।ইতিহাসে তথ্য মেলে যে ঐ অঞ্চলে পাল ও পরবর্তী কালে সেনরাজাদের শাসনকালে প্রজাদের হিতসাধনের জন্য অনেক কূপ এবং দিঘি খনন করা হয়েছিল।
পরিচয় পাওয়া যায় প্রজাবৎসল কল্যাণময়ী মাতৃরূপা এক সম্রাজ্ঞীর, যিনি মহারাজের মনে আস্থা এনে তাঁকে রাজি করাতে হয়তো বা এমনই এক স্বপ্নাদেশের আশ্রয় নেন। তবে আবারও বলছি সবটাই অনুমান মাত্র।সে যাই হোক না কেন,অনুমান আর জনশ্রুতির মোড়কে মোড়া সেই বিশ্বাসটি থাক না কোনো এক গোপন সিন্দুকে, তাতে কী এমন ক্ষতি! ( ক্রমশ )

ফেলে আসা দিনগুলি....
🔴🔵🔴🔵🔴🔵🔴🔵

পঞ্চম পর্ব
■■■■■

সোনার তরী
⭐⭐⭐⭐

ঝাড়গ্রাম মহকুমায় ( বর্তমানে স্বতন্ত্র জেলার মর্যাদায় ভূষিত )যারা ইউটি আর ও (আন্ডারট্রেনিং রেভিনিউ অফিসার ) হিসাবে ইন সার্ভিস ট্রেনিং -এ ছিলাম তাদের মধ্যে অলক চ্যাটার্জি ও অনুপম দাসমজুমদারের নামও রইল পশ্চিম দিনাজপুর জেলায় (অধুনা দক্ষিণদিনাজপুর) বদলির আদেশে। একানব্বইয়ের মার্চ মাসে এক সন্ধ্যায় আমরা তিনজনেই কলকাতায় ধর্মতলা থেকে উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণের বালুরঘাটগামী 'সুপার' বাসে রওনা দিলাম। আহা,কী গালভরা নাম! তবে সুপার মোটেই সু-পাড়ি দেওয়ার জন্য সুখকর নয়। উপায় কী! তখন 'রকেট' বাসের ভাড়া তার নামের সাথে সম্মান রেখে উচ্চগতিসম্পন্ন, যা আমাদের কাছে তখন অধরা। এখন তো রেল যোগাযোগ।পরদিন ভোরে বালুরঘাট। ঐ সক্কাল বেলাতেই এই অধমের নেতৃত্বে 'খাবে কম কিন্তু দুধ ভাল পরিমাণেই দেবে ' এমন এক হোটেল খুঁজে বের করে ঢুকে পড়লাম। তৈরি হয়ে বেলা দশটা নাগাদ তিনজনে তিনখানা জয়েনিং লেটার বাগিয়ে ধরে ডিএলআরও ( জানি আর একখানা 'এল' লাগানো উচিত, অবশ্য তাতে আরও শক্ত হবে কি না জানি না কিন্তু আমরা এই দপ্তরের ছানারা মুখে বলার সময় জিভকে একটু আরাম দিতে পারতাম) অফিসে পা রাখলাম।
কয়েকটা দিন ওখানেই রইলাম।কাজ বলতে সিনিয়র দাদাদের বারংবার অনুরোধ করা যাতে ব্লক পোস্টিং অর্ডার এমনভাবে হয় যে আমরা একসাথে তিনজন মেস করে থাকতে পারি। সেই দাদারা পিতৃবাৎসল্য সুলভ আচরণের পরিচয় দিয়ে সুপারিশ করে ব্লক পোস্টিং অর্ডার করান- আমার বংশীহারি, অলকের তপন ব্লক ও ' ভৌগোলিক ' কারণে( ওজন মাত্র একশো দশ কিলোগ্রাম, কিন্তু ভাগ্য করে অমন সহকর্মী মেলে।আর অনুপমের ছিল অনুপম রসবোধ।সে গল্প নিয়ে পড়ে হাজির হচ্ছি) অনুপমের গঙ্গারামপুর। লক্ষ্য ওই গঙ্গারামপুরেই মেস করে থাকা। কিন্তু বিধি যে বাম ! লক্ষ্য হলেও লক্ষবার চেষ্টা করেও তিনটে ' ডাঁসা ' ব্যাচেলর ছেলের কোনও বাড়িতেই ভাড়া ঘরের হদিস মিলল না। সেই সময়ে গঙ্গারামপুরে কোনও থাকার হোটেলই ( বললাম এই কারণে যে তখনও অবধি ওখানে হোটেল বলতে মূলত 'পাইস হোটেল 'ই বোঝাতো) ছিল না। তবে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। গঙ্গারামপুরেই ধর্মশালার সন্ধান পাওয়া গেল। কিন্তু খুবই অস্থায়ী। ওই সম্প্রদায়ের কোনও অনুষ্ঠান থাকলে আমাদের অন্য কোনও ধর্মশালার তল্লাশে বেরুতে হত। তবে ওখানে পকেটবান্ধব মূল্যে একবেলা 'সাত্ত্বিক ' আহারও জুটে যেত।
তখন মোবাইল ছিল না।তাই ছিল না ফেসবুক আর হোয়াটসঅ্যাপের নেশার মৌতাতে আসক্ত হওয়া।অফিসে সবে নতুন এসে আমরা জয়েন করেছি।তাই কাজের তেমন চাপ ছিল না বা সিনিয়াররা হয়তো আমাদের মতো কচি ছানাদের চাপে রাখতে চাইত না।সন্ধ্যার পরে আমাদের সময় যেন আর কাটতেই চায় না।ভগবান পৃথিবীতে সবাইকেই বুঝি একই পরিমাণ সময় ' অ্যালট ' করেই পাঠান। কিন্তু কারোর দম ফেলারও সময় জোটে না, তো কারোর আবার সময় বুঝি কাটতেই চায় না। এভাবে কিছুদিন কেটে গেলেও চড়ুইপাখির মতো আজ এবাড়ির ঘুলঘুলি থেকে কাল অন্য বাড়ির কার্নিস--- এভাবে আর আমরা পেরে উঠছিলাম না।
একদিন সন্ধ্যাবেলায় অনুপমের অফিসের এক আর আই , শার্দূল মিত্র,(দক্ষিণ দিনাজপুরের হরিরামপুর বিধানসভায় শাসকদলের বিধায়ক এবং রাজ্যের কৃষি বিপণন মন্ত্রী বিপ্লব মিত্রের কনিষ্ঠ ভ্রাতা) ধর্মশালায় এসে ঢুকল। বাঁ হাত জিনসের পকেটে( তখন সবে জিনসের প্রচলন শুরু হয়েছে ) ঢুকিয়ে ডানহাতের তর্জনী বুকে ঠেকিয়ে ফিলমি ভিলেনের স্টাইলে আশ্বাসের বাণী শোনাতে শুরু করল,
----- আমি স্যার শার্দূল মিত্র! কিস্যু ভাববেন না।আমি আছি না!
এরপর কথার ফুলঝুরি ছুটিয়ে তার নানান 'বীরগাথা'-র বর্ণনা দিতে লাগল।
---- কাল আপনাদের একটা বাড়ি ঘুরিয়ে দেব।
এরপর গলা নামিয়ে,
------ তবে বাড়িওয়ালা একটু ..... , বলেই কিছু বুঝে ওঠার কোনও সুযোগ না দিয়ে ধাঁ করে বেরিয়ে গেল।
পরদিন সন্ধ্যায় তিন মূর্তি আর আই সাহেবের নেতৃত্বে উদ্দিষ্ট বাড়িওয়ালার সমীপে পৌঁছাতে রওনা দিলাম।আমার কী মনে হওয়ায় সকালেই একটা দশটাকার নন-জুডিসিয়াল স্ট্যাম্প পেপার আনিয়ে রেখেছিলাম।এগ্রিমেন্ট-ফেগ্রিমেন্ট যদি করতে হয়,এমন আশঙ্কায়।
দোতলায় উঠে বসার ঘরে পা দিতেই, বছর পঞ্চাশেক বয়স হবে,লুঙ্গি পরা আদুল গা, তাম্বুল রঞ্জিত দাঁত বার করে এগিয়ে এলেন,
--- আরে! শার্দূল আইচ।
আমাদের দিকে তাকিয়ে স্বাগত ভঙ্গিতে,
---- আসেন,আসেন! বয়েন।
আমরা তিনজনে শতরঞ্জি বিছানো একটা চৌকিতে শঙ্কিত হয়ে বসে পড়লাম।
আলাপ পরিচয় সেরে উনিই কাজের কথা পাড়লেন,
---- দ্যাখেন! ঘর ভাড়া দেওয়ার তেমন ইস্যাই নাই।নেহাত শার্দূল নিয়া আইচে তাই! নিচে একতলায় বামদিকের ঘরখান ভাড়া দিছিলাম। চারখান কলেজের চ্যাংড়া।কী আর কমু সে কথা! মদ খাইত, তাসও খেলত, আবার পয়সা দিয়া, ভাবেন দিকি, বলে আমার দিকে তাকাতেই আমি হাঁ হাঁ করে উঠলাম,
------ ছি ,ছি! ভদ্রলোকের বাড়িতে এসব করা একেবারেই অনুচিত।
এবার সরাসরি ওনার চোখে চোখ রাখলাম,
----- আমাদের ব্যাপারে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আশাকরি আর আই সাহেবের কাছে আমাদের পরিচয় পেয়ে গেছেন।
জীবনে চলার পথে সমস্যা এসে হয়তো আমাদের দিশেহারা করে তোলে।ঠিকই! কিন্তু এটা সাময়িক। আমি আমার কর্ম জীবনের অভিজ্ঞতার বিনিময়ে এটুকু জেনেছি সর্বদাই এবং তৎক্ষণাৎ সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়,এড়িয়ে যাওয়ার বাহানা দেখালে আরও পাঁচটা সমস্যা ঘিরে ধরে। আর সবথেকে বড় কথা -- সত্যি করে বলুন তো ! ঝামেলাকে স্ট্রেট ব্যাটে না খেলতে পারলে জীবনটা আলুনি ব্যঞ্জনের মতো নয় কি ?
এবার হঠাৎ পকেট থেকে স্ট্যাম্প পেপারখানা ফস্ করে বার করে মেলে ধরলাম,
---- ঠিকই তো!মুখের কথার কোনও দাম আছে না কি? বলুন ।আপনার সব শর্তগুলো লিখে আমরা তিনজনেই সই করে দিচ্ছি।
উনি প্রায় আৎকে উঠে আমার দিকে ঝুঁকে পড়লেন,
---- আরে না,না, প্রবীরবাবু! এ সবের কোন্ দরকার নেই।আপনার মুখের কথাই যতেস্ট।
আমাদের আলোচনায় শার্দূল মিত্র মশাই একেবারেই মাথা গলাল না।পরিবর্তে ঐ বাড়িতে তার ' পপুলারিটি' জানান দিতে এ ঘর ও ঘর ঢুঁ মেরে ভয়ঙ্কররকম বিজ্ঞের ভাব দেখিয়ে কিশোরী কন্যাটির পড়াশোনার খোঁজ নিতে লাগল।
একতলায় ডানদিকে দুটো ঘর। রান্নার জায়গা।আলাদা টয়লেট। সব ভাড়াটেদের কমন টয়লেট ওইসব অঞ্চলে তখন কমন ব্যাপার।ভাড়া তিনশো পঁচাত্তর। মাসের প্রথমেই, পাঁচ তারিখের মধ্যে দিতে হবে।একমাসের এডভান্স।একবছর হলেই দশ শতাংশ এনহ্যান্সমেন্ট।
উঠে আসার সময় আড়চোখে দেখে নিলাম রূপবতী গৃহকর্ত্রী ( পরে আমাদের সবার প্রিয় বৌদি হয়ে ওঠেন ),বাড়িওয়ালা মানে রমেন রায়ের সাথে একদমই ম্যাচ করে না-- ঐ অনেকটা দামি কোট-প্যান্টের স্যুটের সঙ্গে হাওয়াই চটি আর কী ( আরে না না! ভুলেও কেউ যেন এই চটির সাথে আবার সাম্প্রতিক প্রসঙ্গের অবতারণা না করেন।শান্তশিষ্ট পত্নীনিষ্ঠ ছাপোষা গোবেচারা আমি! বেঘোরে বুঝি প্রাণটা যাবে।)! কিশোরী কন্যাটিও বেশ সুন্দরী।অলোক আর অনুপমেরও নজর এড়াল না। যাইহোক বেরিয়ে এসে আমার এগ রোল পাওনা হল। ভোজনরসিক ( সেই গল্পে পড়ে আসছি) অনুপম প্রযোজকের ভূমিকায় এগিয়ে এল। রাস্তার মোড়ের দোকানে অর্ডার দেওয়া হল।
সেটা ছিল বৃহস্পতিবারের সন্ধ্যা।শনিবার ছুটি।ঠিক হল শনিবার ঐ নতুন ঠেকে আমাদের অভিষেক হবে।মাথা গোঁজার না হয় একটা ঠাঁই হল। কিন্তু এই তিন আইবুড়োর রাজ্যপাট সামলাবে কে? নব্য বাড়িওয়ালা রমেন রায়ই মুশকিল আসান করে দিলেন।বুড়ি মাসি।শিববাড়িতে বাড়ি।আমাদের ' লোকাল গার্জেন' হিসাবে পাকাপাকি বন্দোবস্ত হয়ে গেল। যেকোনো কথা বলার আগে অধিকাংশ সময়ে 'কেরো ' অব্যয় দিয়ে শুরু করত। তাই অবিলম্বে এহেন মাসি কাম 'লোকাল গার্জেন' 'কেরো মাসি ' নামে অভিহিত হয়ে গেল। তিনটে অজানা আর অচেনা কম বয়সী ছেলে।জীবিকার টানে এই উজানে আসতে হয়েছে।কিন্তু সেই বিদেশ-বিভূঁইয়ে কীভাবে যে মায়া আর স্নেহের আঁচলে বুড়ি মাসি সদা আমাদের আগলে রাখত তা ভাবলে আজও আবেগ আর বিস্ময়ে অবাক হয়ে যাই। বাজার করা, রান্না করা, পরিবেশন, ঘরের কাজ, কেউ অসুস্থ হলে অনলস সেবাশুশ্রুষা, কারোর অফিসের কারণে বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে দেরি হয়ে গেলে তাকে স্নেহের ধমকে জোর করে বাড়ি পাঠানো মায় পুজোপার্বনে চাঁদা নিতে এলে চাঁদার পরিমাণ 'অন্যায্য ' থেকে ' ন্যায্যতে' নামিয়ে আনা-- তাঁর 'লোকাল গার্জেন'-এর সংজ্ঞা অনেক বিস্তৃত। আমায় ডাকত সাহেব, অলককে নাতি , যেহেতু তার নাতির নাম আর অনুপমকে 'আনুপম' , বোধহয় ওর ভৌগোলিক কলেবরে নাম পরিবর্তন করতে সাহস পায়নি বলে ।
শনিবার দুপুরে মাসির নির্দেশে এবং উপস্থিতিতে আমরা গঙ্গারামপুরের হাটে গেলাম। ওখানে পৌঁছে দেখলাম কেরো মাসির জনপ্রিয়তা যে কোনো দুঁদে রাজনৈতিক নেতৃত্বকেও বুঝি লজ্জায় ফেলে দেবে।হাঁকডাকে সব জোগাড় করে ফেলল।সত্যিই! গ্রাম্য হাট যেন নিছক কেনাবেচার স্থান নয়,বুঝি মিলনমেলাও বটে।একটু বেশিই মানে বক্সিগঞ্জে পদ্মাপারের হাটের থেকে পুনর্ভবার তীরে গঙ্গারামপুরের হাটে যেন একটু বেশি কিছুই উপলব্ধি করতে পারলাম।পারস্পরিক কুশল বিনিময়, নানা খোঁজখবর ,সুখদুঃখের শেয়ার করা--- কারোর ছেলের কাজের সংস্থান হল কিনা, কারোর বৃদ্ধা শাশুড়ির ইহলোক ত্যাগ কিংবা কারোর গরুর বকনা বাছুর প্রসব, এমন আরও কত কী! তিনটি চৌকি কেনা হল। নেওয়া হল গৃহাস্থালীর নিতান্ত প্রয়োজনীয় কিছু সামগ্রী।বলাই বাহুল্য,সবই কেরো মাসির কেরামতি। আমরা নির্বাক দর্শক মাত্র।ঐ দিন সন্ধ্যা থেকেই আমাদের ' জয়েন্ট ভেনচার ' শুরু।ওরগ্রামের সাথে এখানেও মিল। আবার আমাকে মেস ' ম্যানজার ' হতে হল। আবার ঘর পিছু তিন চৌকিতে তিন পিস্। যদিও বড় বড় দুটো ঘর, তবু সামনের ঘরটাতেই সবার বাসনা হল আঙুরের থোকা হয়ে একসঙ্গে থাকার।

(ক্রমশ)

prabir chat1.jpg

সংযোগসূত্র সার্ভে টিম

ফিল্ড ইন্সট্রাক্টরঃ বৈদ্যনাথ সেনগুপ্ত

ফিল্ডবুক রাইটারঃ সমীর ভট্টাচার্য

ফিল্ড সুপারভাইজারঃ রামচন্দ্র ঘোষ ও আশীষ সরকার

bottom of page